দরপতন অব্যাহত

পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২

এম সাইফুল
প্রতিকী ছবি

পাভেল আহমেদ ৫০ লাখ টাকা নিয়ে শেয়ারবাজারে এসেছিলেন। এই টাকার বিপরীতে আরও ৫০ লাখ টাকা মার্জিন ঋণ নিয়ে প্রায় এক কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিলেন। অব্যাহত দরপতনে তার কেনা শেয়ারের দাম কমে এখন ৫০ লাখের নিচে চলে এসেছে। ব্রোকারেজ হাউজ থেকে বিক্রি করে দেওয়ার চাপ দিচ্ছে। বিক্রি করে দিলে ঋণ সমন্বয় করে তাকে খালি হাতে ফিরতে হবে। স্বেচ্ছায় বিক্রি না করলে ব্রোকারেজ হাউজ ‘ফোর্সড সেল (জোরপূর্বক) করতে পারবে। লাভের আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এভাবেই সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগারীরা।

তথ্য মতে, গত ৫ বছরে পুঁজির কিছু অংশ লোকসান দিয়ে বা সর্বস্ব হারিয়েছেন প্রায় ৭ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও হিসাবধারী। পাশাপাশি বাজার ছেড়েছেন এক লাখের বেশি বিদেশি বিও হিসাবধারী। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরে দেশি-বিদেশি (অনাবাসী) বিনিয়োগকারীসহ মোট বিও হিসাব ছিল ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫০টি। এর মধ্যে দেশি বিও হিসাব ছিল ২২ লাখ ১১ হাজার ২৫৭টি। আর অনাবাসী (নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি) বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৩টি। প্রায় ৪ বছর ১১ মাসের ব্যবধানে ২০২৪ সালের ২৩ নভেম্বর বিও কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ১২৮টিতে। এই সময়ে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে হয়েছে ১৬ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৯টি।

অর্থাৎ দেশি বিও হিসাব কমেছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৮টি। আর অনাবাসীদের বিও কমে হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৬১টি। অর্থাৎ তাদের বিও কমেছে ১ লাখ ১ হাজার ৭৩২টি।

ডিএসইর তথ্য মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশিরা ৯ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন। একই সময়ে বিক্রি করেছেন ১৭ হাজার ৭১ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ এ সময়ে তারা মুনাফা তুলেছেন ৭ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।

বিপুল পরিমাণ মুনাফা করার পরও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে আস্থার সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ার বড় কারণ আস্থার সংকট। সুদহার বাড়ায় দেশি বিনিয়োগকারীদের বড় অংশও বাজার ছেড়েছেন।

তথ্য মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশিরা ৯ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন। একই সময়ে বিক্রি করেছেন ১৭ হাজার ৭১ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ ৭ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার মুনাফা তুলে নিয়েছেন তারা।

সিডিবিএলের তথ্য মতে, ২০২০ সালের অক্টোবরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫০টি। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীর বিও সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৩টি। প্রায় ৪ বছর ১০ মাসের ব্যবধানে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবরে বিও দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৬টিতে। এই সময়ে বিদেশিদের বিও কমে হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৫৫টি। অর্থাৎ ১ লাখ ১ হাজার ৬৩৮টি বিও হিসাব কমেছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৬৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকায়। মূলধন কমেছে ১ লাখ ৪ হাজার ২৯১ কোটি টাকা।

ডিএসইর তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বাজারে লেনদেন হয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৩ কোটি টাকার শেয়ার, বন্ড এবং মিউচুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করেছেন ২ হাজার ১৬৭ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার ২৩৯ টাকা, যা মোট লেনদেনের ২ শতাংশ। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২৩০ কোটি টাকার বেশি শেয়ার। এর মধ্যে বিদেশিদের লেনদেন ৩ হাজার ১০৪ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার ৭১৫ টাকা। অর্থাৎ এ বছরও বিদেশিদের অংশগ্রহণ ২ শতাংশের মধ্যেই।

অথচ পার্শ্ববর্তী শ্রীলংকার পুঁজিবাজারে বিদেশিদের অংশগ্রহণ ৭ শতাংশ, পাকিস্তানের বাজারে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা দরপতনে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। তাদের অনেকের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়ছে। শেয়ারের দাম কমে যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে যায়, তখন ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীকে নতুন করে অর্থ বিনিয়োগের তাগাদা দেওয়া হয়। যদি কোনো বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ না করেন, তখন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক তার শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করে নেয়। শেয়ারবাজারে এটি ‘ফোর্সড সেল’ হিসেবে পরিচিত। বাজারে যত বেশি দরপতন হতে থাকে, ‘ফোর্সড সেলের’ চাপও তত বাড়তে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারের দিক থেকেও মন্দা বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ ছিল না। অন্যদিকে কারসাজির ঘটনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর পদক্ষেপের ফলে বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় ধরনের সংকট রয়েছে।

অনেকে বলছেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, রাতারাতি নীতি পরিবর্তন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া সুদহার বৃদ্ধি ও আস্থার সংকটের কারণেও বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য যেসব বিও খোলা হয়েছিল প্রো-রাটা পদ্ধতি চালুর পর সেসব বিওধারী বাজার ছেড়েছেন।

তাদের মতে, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনরুদ্ধার না হলে সংকট আরও দীর্ঘ হবে। এতে আরও বিনিয়োগকারী হারানোর শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আগে আইপিওর ক্ষেত্রে এক সময় লটারি পদ্ধতি ছিল। এতে লটারির মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হতো। ২০২১ সালে এই পদ্ধতি তুলে দিয়ে আনুপাতিকহারে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার পদ্ধতি চালু হয়। এই পদ্ধতি প্রো-রাটা বলে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে আইপিও আবেদনের আগে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর বাজারমূল্যে ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে তথা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ থাকতে হবে। অর্থাৎ আইপিও আবেদন করার আগে একজন বিনিয়োগকারীর সেকেন্ডারি বাজারে ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে। আর অনাবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগ থাকতে হবে ১ লাখ টাকা। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর পুঁজিবাজার থেকে অনেক বিও হিসাবধারী চলে গেছেন।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের বাজারে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। তাই বাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রাতারাতি ও এককভাবে কারও পক্ষে বাজার থেকে সব অনিয়ম দূর করা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজই করতে হবে বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজারসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্য খারাপ না হলেও তারা নিজেদের পুরোপুরি বাজারবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাই বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ হচ্ছে।’

যাযাদি/ এসএম