‘ওয়ান ব্যাংক তার উদ্ভাবনী সেবাগুলোর মাধ্যমে আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে’
প্রকাশ | ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৪৪ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৫১
তারল্য সংকট, নীতি সুদহার বাড়ানো, রিজার্ভ পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স আহরণ, অর্থ পাচার সহ বর্তমান ব্যাংকিং খাতের নানাদিক নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনজুর মফিজ।
প্রশ্ন : বর্তমানে দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত কোন অবস্থায় আছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আছে বলে মনে করেন কী?
উত্তর : বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত একটা সামগ্রিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অনেকদিন পর একটা নতুন উদ্যম, নতুন চিন্তা নিয়ে নতুনভাবে দেখার সুযোগ এসেছে। একটা পথনকশা, নতুন নির্দেশনা, সুশাসন এবং সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং বিপুল কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে নতুনভাবে ব্যাংকিং খাতের সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের সবাই মিলে সে সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে।
বর্তমানে কিছু কিছু ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি আছে। তবে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য পরিস্থিতি বিরাজ করছে; টাকার অংকে যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বেসরকারি বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা যেমন এসেছে, আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসায় ব্যাংকে আমানত এবং তারল্যও বেড়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল হবে এবং ঋণপ্রবাহ বাড়বে তখন তারল্য পরিস্থিতিও একটা ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে আসবে।
প্রশ্ন : ব্যাংকিং খাতে সুদের হার নিয়ে সব সময়ই সমালোচনা হয়; বাংলাদেশে ঋণের সুদের হার বেশি, অন্যদিকে আমানতের সুদের হার কম, এ বিষয়ে আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা কী?
উত্তর : আমানতের সুদের চেয়ে কিন্তু ঋণের সুদের হার বেশিই হওয়ার কথা, সারা বিশ্বেই তাই। তা না হলে কিন্তু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো ব্যাংক টেকসই হবে না।
তবে দেখার বিষয়, দুই হারের পার্থক্য কতটা যৌক্তিক, সেই প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা। এ ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি, কোনো ব্যাংকের পক্ষেই কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হওয়া বা অযৌক্তিক হারে সুদের হার নির্ধারণ করা সম্ভব না। বর্তমানে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঝুঁকি এবং জামানত বিবেচনায় ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে।
প্রশ্ন : ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অনেকেই চাহিদা মতো ঋণ পায় না; বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তারা এই অভিযোগ করে থাকেন, অনেক ছোট উদ্যোক্তা জামানত দিতে পারে না বলে ঋণ পায় না, এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
উত্তর : ব্যাংকিং কিন্তু একটা খুবই কাঠামোবদ্ধ ব্যবসা। এখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকারের প্রথম বিবেচনা হলো- ঋণগ্রহীতা ব্যবসা করে অর্জিত নগদপ্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) থেকে ঠিক সময় ঋণের অর্থ সুদসমেত ফেরত দিতে পারবেন কিনা। সুতরাং, ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত কিছু বাছাই প্রক্রিয়া এবং বাছ-বিচারের মাধ্যমেই নেয়। তবে সিএসএমই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের কথা বিবেচনা করে ওয়ান ব্যাংক জামানতবিহীন এবং স্বল্প জামানতে ঋণ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএসএমই পলিসির আলোকে সব ব্যাংকই কিন্তু এই খাতে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে সামগ্রিক চাহিদা বিবেচনায় এই খাতে ঋণের প্রবাহ আরও বেশি হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
প্রশ্ন : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার (নীতি সুদ) প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমছে না কেন?
উত্তর : মূল্যস্ফীতি কিন্তু কমছে। গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ পার্সেন্ট, যা সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৯২ পার্সেন্টে নেমে এসেছে এবং এখন আরও কমে আসবে। নীতি সুদহার ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা সারা দুনিয়ায় একটা পরীক্ষিত পদ্ধতি। তবে আমাদের বাজারে আরও অনেক প্রভাবক কাজ করে।
বন্যা-পরবর্তী সময় বাজারে কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল আছে। আশা করা যায়, বছরের শেষ ভাগে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে।
প্রশ্ন : বর্তমানে দেশে রিজার্ভ পরিস্থিতি কি উন্নত হচ্ছে? রিজার্ভ নিয়ে এখন আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ আছে?
উত্তর : বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নতির ধারায় ফিরেছে। রিজার্ভ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই; তবে সতর্ক থাকার দরকার আছে। পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সতর্ক চোখ রাখতে হবে; কারণ আমাদের রিজার্ভে রেমিট্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রশ্ন : রেমিট্যান্স আহরণে ওয়ান ব্যাংক কী কী উদ্যোগ নিচ্ছে?
উত্তর : ওয়ান ব্যাংক পিএলসি আমাদের সম্মানিত রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে এসেছে। এই ব্যাংকে সহজে ওয়েজ আর্নার্স অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, ইএফটি/টিটি সার্ভিস এবং অনলাইন সার্ভিস ছাড়াও ২৪ ঘণ্টা ডেডিকেটেড কল সেন্টার খোলা থাকছে গ্রাহকদের সেবায়। এ ছাড়া আছে আমাদের শতাধিক শাখার পাশাপাশি সাব ব্র্যাঞ্চ এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক।
প্রশ্ন : ব্যাংকে ডলারের দাম কম হওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসে বলে শোনা যায়; এ বিষয়ে সরকারের করণীয় কী?
উত্তর : সরকার কিন্তু ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এখন ইন্টার ব্যাংক লেনদেন বেড়ে গেছে। তাই কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দামের পার্থক্য এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। সুফলটাও দৃশ্যমান হয়েছে, রেমিট্যান্স প্রবাহে নাটকীয় প্রবৃদ্ধি এসেছে।
প্রশ্ন : বিগত সরকারের সময় ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করেছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ এসেছে; পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উপায় কী?
উত্তর : দেখুন, বর্তমান সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গভর্নর মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই কমিটির ব্যাপ্তি দেখে এবং কমিটিতে যারা কাজ করছেন, তাদের দেখে কিন্তু আশাবাদী হতে হয়। তাদের সবার খুব ভালো ট্র্যাক রেকর্ড আছে। আমি খুবই আশাবাদী যে, এই টাস্কফোর্স এ বিষয়ে ঠিক উদ্যোগ নেবে এবং সফল হবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, ভবিষ্যতে কি ব্যাংকের একীভূত (মার্জ) হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন?
উত্তর : বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ((PCA Framework)) তৈরি করেছে। এখন এই ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে মূল্যায়ন করা হবে এবং সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তীতে মার্জারের সুযোগ আছে। দেখা যাক কী হয়? তবে এগুলো পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্তের বিষয়। আগাম বলা যাবে না।
বাণিজ্যিক বিবেচনায় সারা বিশ্বেই মার্জার হয়; আমাদের দেশেও হয় এবং হয়ত ভবিষ্যতেও হবে। বিভিন্ন কারণেই একাধিক ব্যাংকের মার্জার বা ব্যবসার একীভূতকরণ হতে পারে; তবে এ ধরনের একীভূতকরণ স্বেচ্ছায় হলেই ভালো হয়।
একীভূতকরণের মূল লক্ষ্য হলো, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার নিরসন এবং শক্তিশালীকরণ। এটা একটা স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত, অংশগ্রহণকারী ব্যাংকসমূহ তাদের উদ্দেশ্য, মূলধন ও সম্পদের মান, মানবসম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে পুঙ্খানুপঙ্খ বিবেচনা করেই মার্জারে যাওয়া উচিত। মার্জার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সময়ের প্রেক্ষিতে এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরেকটি বিষয় হলো, মার্জারের মাধ্যমে একক প্রতিষ্ঠান যেন কনসানট্রেসন ঝুঁকি বাড়িয়ে না নেয়। বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখেছি, Ôtoo big to failÕ ধরনের প্রতিষ্ঠান পুরো আর্থিক খাতের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকেই জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়সাধ্য করে তোলে।
প্রশ্ন : গ্রাহকদের জন্য ওয়ান ব্যাংক কী কী ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
উত্তর: ওয়ান ব্যাংকের লক্ষ্য আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া। ওয়ান ব্যাংক বর্তমানে ১১১টি শাখা, ৪৫টি উপ-শাখা, ১৭৪টি এটিএম এবং ২৪১টি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে বিস্তৃত ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে, যা একই ছাদের নিচে পাওয়া বিরল। আমাদের ওয়ানঅ্যাপ ইন্টারনেট ব্যাংকিংঅ্যাপ গ্রাহকদের টাকা ট্রান্সফার, বিল পেমেন্ট ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাসহ আরও নানা সুবিধা প্রদান করছে, যেখানে ওকে ওয়ালেট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক লেনদেনকে সহজ ও নিরাপদ করেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংকিংসেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং বাংলা কিউআর ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের নগদবিহীন লেনদেনে সক্ষমতা দিয়েছে। সর্বোপরি, গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে আমাদের গ্রাহকসেবা সবসময়ই অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যা ওয়ান ব্যাংককে আরও গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।
প্রশ্ন : গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে ওয়ান ব্যাংকের করণীয় কী?
উত্তর: ওয়ান ব্যাংক তার উদ্ভাবনী সেবাগুলোর মাধ্যমে আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে, যেমন প্রবাসীদের জন্য নন-ফেস-টু-ফেস অ্যাকাউন্ট এবং কালেকশন সার্ভিস, যার মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংক নিজ ব্যাংকের গ্রাহকদের পাশাপাশি অন্য ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকেও প্রিমিয়াম ও সার্ভিসেস সংগ্রহ করতে পারে। আমরা ই-কেওয়াইসিভিত্তিক অ্যাকাউন্ট ওপেনিং এবং ওয়ানঅ্যাপ থেকে ডিপিএস ও এফডি খোলার সুবিধা অতিসত্বর চালু করতে যাচ্ছি, যা গ্রাহকদের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা আরও সহজ ও নিরাপদ করবে।
যাযাদি/ এস