আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক ব্যবহার
গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির বিলে শত কোটি টাকার কারচুপি
প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৫
রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাতে কোনোরকম নিয়ম-নীতি ছাড়াই আবাসিক ভবনে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাড়ির মালিক ও সংশ্লিষ্টদের অর্থের লোভের কারণে দিনের পর দিন বাড়ছে এ সব প্রতিষ্ঠান। ফলে অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এত কিছুর পরেও এ বিষয়ে বাড়ির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের নেই কোনো তৎপরতা।
রাজধানীর বনশ্রী, খিলগাঁও তালতলা, আফতাবনগর, বাড্ডা, বেইলি রোডসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অনুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়ির মালিক অধিক লাভের আশায় বসবাসের আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অস্বাভাবিক অগ্রিমসহ গোপনে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। অনেক ভাড়াটিয়া এ বিষয়ে বাড়ির মালিককে অভিযোগ করলেও নেওয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। বরং যে সব ভাড়াটিয়া প্রতিবাদ করেন তাদের পড়তে হয় নতুন নতুন ঝামেলায়।
এদিকে বাড়ির মালিকরা জানান, ‘আমরা রাজউক থেকে অনুমতি নিয়েই ভাড়া দিয়েছি।’ রাজউকের কাগজ দেখতে চাইলে সব বাড়ির মালিকই দেখাতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনশ্রীর এক বাড়ির মালিক জানান, এগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। যেসব দপ্তর থেকে অডিট আসে তারা নিজেরাও মাস শেষে পায় মোট অংকের অর্থ।
অপরদিকে, বাণিজ্যিক ভাড়াটিয়ারা জানান, আমাদের ব্যবসার পরিধি ছোট। নিজেদের লোকবল কম। আবার বাহির থেকে লোকজন তেমন আসে না। তাই সমস্যা হয় না। বেইলি রোডের মামুন নামে এক ভাড়াটিয়া জানান, ‘আমি অফিস নিয়েছি বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তি করে। তিনি আমাকে বলেছেন তার রাইটস আছে। কিন্তু নেওয়ার পর সাইনবোর্ড ইউজ করতে দেয় না। অফিস নিয়েছি তা অন্য ভাড়াটিয়াকে বলতে বারণ করেছে। তাই আমি অফিস ছেড়ে দেবো।’
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বাড়ির মালিকরা গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ ইউটিলিটি বিল কমানোর জন্য আবাসিক ভবনে অফিস দিলেও বলতে নারাজ। এছাড়াও রাজউকসহ সিটি করপোরেশনের অনুমতি না থাকায় তথ্য গোপন রাখতেই মরিয়া হয়ে যায়। যদিও কোনো দপ্তর খবর জানতে পারে তাদেরই দেয়া হয় উৎকোচ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের অসাধু বাড়িওয়ালাদের কারণেই অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে। এ সব দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে একটা সময় এসব বাড়ির মালিক বড় ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করবে। পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এছাড়াও তাদের কারণে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। কারণ প্রতিমাসে রাজধানীর দুই সিটিসহ সারাদেশে যত টাকা ইউটিলিটি বিল ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, তা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বছর শেষ হিসাব করলে দেখা যাবে কোটি কোটি টাকা সরকারের ক্ষতি হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা মডস জোন-৬ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম জানান, আবাসিক ভবনে সাধারণত কর্মাশিয়াল প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়ার নিয়ম নেই। যদি এ রকম কেউ ভাড়া দিয়ে থাকে তাহলে সেখানে আবাসিক বিল কখনো হবে না। আবাসিক ভবনের পানি বিলের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিল রাত আর দিন তফাৎ। যদি কেউ তথ্য গোপন করে এমনটা করে থাকেন তাহলে তার জরিমানাসহ লাইন বন্ধ করে দেয়া হবে। সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান জানান, বর্তমানে আবাসিক অনেক ভবনে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হয়। ওই সকল ভবনে আবাসিকের বিল ও বাণিজ্যিক বিল দুটিই আলাদা। আমাদের কাছে এখনো এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি অভিযোগ আসে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান (অব.) জানান, রাজউকের অনুমতি ব্যতীত কোনো ভবনে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়ার এখতিয়ার নেই। জুলাই থেকে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। যেখানেই এই অভিযোগ পাওয়া যাবে সেখানেই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিছু কিছু এলাকায় বাণিজ্যিক ও আবাসিক একসঙ্গে ভাড়া দেয়া হয়। সেখানে রাজউকের অনুমতি রয়েছে। তাই রাজউকের অনুমোদনের বাহিরে গিয়ে ভবন নির্মাণ কিংবা পুরো আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ জানান, অবৈধ অনেক গ্যাস লাইন ইতোমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে। কিছু সিন্ডেকেট অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করে। আমরা এসব সিন্ডেকেট অনেকটাই কমিয়েছি। তবে এখন আবার অভিযান চলমান রয়েছে। অভিযানে সব অবৈধ লাইন বন্ধ করা হবে। যদি কোথাও অবৈধ লাইন ব্যবহার করা হয় আমাদের কাছে অভিযোগ করলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যাযাদি/ এসএম