মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১

বাঁধা আয়ে চলছে না সংসার, বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৫
ছবি: সংগৃহীত

আঠারো হাজার টাকা বেতনে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করা আখতার-উজ-জামানের সংসারে টানাপড়েন ছিল বেশ আগে থেকেই। বিভিন্ন বাজেট কাটছাঁট করে কোনোরকমে খেয়েপড়ে চলছিল সংসার। তবে নতুন করে মাছ-ডিম, তেল-চাল ও সবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় তার বাঁধা আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ অফিসের বেতন বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই নিরুপায় আখতার-উজ-জামান নিজের জমানো কিছু টাকা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে বাসার সামনে স্ট্রিট ফুডের দোকান বসিয়েছেন। সারাদিন তার স্ত্রী ও ছেলে এ দোকান সামলাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে তিনি দোকানের হাল ধরছেন।

সেখান থেকে প্রতিদিন ৩/৪শ’ টাকা আয় হওয়ায় সংসার চালানো কিছুটা সহজ হয়েছে। তবে স্থানীয় বখাটেরা প্রতিদিন দুইশ’ টাকা করে চাঁদা চাওয়ায় এ ব্যবসা কতদিন চালাতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। তাই চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই পেতে বিভিন্ন জনের কাছে ধর্না ধরছেন।

তার মতো বাঁধা আয়ের অনেক গৃহকর্তাই এখন একাধিক কাজ করে পণ্যমূল্যের ধাক্কা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তান, এমনকি গৃহবধূরাও কেউ কেউ ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা কোনো কাজ করে সংসারের বাড়তি চাপ কাঁধে তুলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

সুন্দরবন ট্যুরিজমের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন জানান, তার বাসা ভাড়া বাবদ দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। তিনজনের পরিবারের খাওয়ার খরচ ৭-৮ হাজার থেকে বেড়ে ১১ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। কলেজ পড়ুয়া ছেলের পড়াশোনার পেছনে ৩-৪ হাজার টাকা খরচ। এছাড়া নিজের যাতায়াত খরচ ও চিকিৎসা ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খরচ ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা। অথচ তিনি বেতন পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। তাই বাড়তি আয়ের জন্য বাড্ডার পোস্ট অফিস গলিতে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়েছেন।

ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘চাকরি করে ৪০ হাজার টাকার মতো জমিয়েছিলাম। কিন্তু গত দুই মাসেই জমানো টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়ে গেছে। ভাবলাম এভাবে চললে জমানো টাকাগুলোও সব শেষ হয়ে যাবে। পরে নিজের ৪০ হাজার টাকা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া এক লাখ টাকা দিয়ে দোকানটি করেছি। চাকরির পাশাপাশি দোকান চালানো কষ্টকর হলেও কোনো উপায় নেই।’

মটরপার্টস বিক্রি করে এমন একটি দোকানের ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। চাকরি করার পাশাপাশি তিনি নিজেই ছোট্ট একটি স্টেশনারির দোকান দিয়েছেন। যেটা তার ভাই দেখাশোনা করছেন, তিনি বসছেন চাকরির নির্দিষ্ট সময়ের পরে।

জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এখনও দোকান থেকে খুব বেশি আয় হয় না। দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন দিয়েই লাভ শেষ হয়ে যায়। তবে আশা করছি সামনে কিছু আয় হবে। অল্প হলেও আয়ের একটি উৎস থাকায় কিছুটা চিন্তামুক্ত লাগছে।’ যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে তাতে বাড়তি কোনো ইনকাম না করলে সংসার চালানো কষ্টকর। ৫ সদস্যের পরিবার টানতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে- জানান তিনি।

একই অবস্থার মধ্যে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর হোসেন। আদাবরের এই বাসিন্দা চাকরির ২০ হাজার টাকা দিয়ে ঘরভাড়া, সন্তানের স্কুলের খরচ, খাওয়ার খরচ টানতে পারছিলেন না। শেষে ধারদেনা করে একটি বাইক কিনে চাকরির সময় শেষে রাইড শেয়ারিং করছেন।

জাহাঙ্গীর জানান, পেট্রোল খরচ বাদ দিয়ে রাইড শেয়ারিংয়ে প্রতিদিন ২/৩শ’ টাকা লাভ থাকছে। তাই কষ্ট করে হলেও এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এরপরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার আশঙ্কা, খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে প্রতিদিনই বাড়ছে তাতে আগামীতে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে অনেকের বাবা-মা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ টানতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র অবস্থায়ই কেউ কেউ আয়ের পেছনে ছুটছে। এরকম একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় নিউমার্কেট মোড়ে।

এনামুল হোসেন নামে এই শিক্ষার্থীর গ্রামের বাড়ি যশোর। থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের শ্যামলীতে। পরিবার এতদিন টাকা দিলেও মাস দুয়েক হলো টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকায় থাকা খাওয়া পড়ার খরচ জোগাতে বাধ্য হয়েই রাইড শেয়ারিং করে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে।

সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মেসে খাবারের অবস্থা এখন খুবই নিম্নমানের বলে জানান তিনি। এনামুল বলেন, মেসে প্রতি বেলা খাবার খরচ আগে হতো ৬৫ টাকা, এখন হয় ৮৫ টাকা। তাও বেশিরভাগ সময়ই ডাল, ডিম ও সবজি রান্না হয়। সপ্তাতে দুই দিন মাছ ও একদিন ব্রয়লার মুরগি রান্না হয়। মাছ ও মুরগির পিসও এখন ছোট হয়ে গেছে। তারপরও থাকা ও খাওয়াবাবদ ৬ হাজার টাকা খরচ। যা এখন তাকে জোগাড় করতে হচ্ছে।

মোহাম্মদপুরের দুটি বাসায় কাজ করেন গৃহপরিচারিকা কুলসুম বেগম। দুই বাসা থেকে তার আয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের এই মানুষটিও। তিনি দুটি কাজের পাশাপাশি আরও কাজ খুঁজছেন বলে জানান।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নিত্যপণ্যের বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে নাভিশ্বাস অবস্থা ক্রেতাদের। নাগালে নেই মাছ-মাংস, ডিম-সবজি কোনোকিছুই। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে বাজার চলছে দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। কমার কোনো লক্ষণ নেই কোনো পণ্যেই। এতে নাজেহাল অবস্থা সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে যারা বাঁধা আয়ের মানুষ।

মালিবাগ বাজারে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, বাজারে ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। তেলাপিয়া মাছও ২৮০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে না। ডিমের ডজন ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকা। এ অবস্থায় স্বল্প আয়ের মানুষ বাজারের এ মাথা থেকে ওমাথা ঘুরে কী কিনবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না।

একই বাজারে আসা মতিঝিলের একটি প্রাইভেট ফার্মের জুনিয়র অফিসার শাহজাহান আলী জানান, শেষ কবে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরেছি জানি না। সরকার পতনের প্রথম সপ্তাহ ছাত্রদের তদারকিতে দাম কিছুটা কমেছিল। এরপর আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে বাজার পরিস্থিতি। এভাবে চলতে থাকলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে।

রামপুরা বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী ইমাম মেহেদীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাছ-মাংস খাওয়া তো আগেই কমিয়েছি। এখন সবজির বাজারও হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নাগালে নেই চালের দামও। আমরা সাধারণ মানুষ কী খেয়ে বাঁচব!’

গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দামে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে প্রায় প্রতিটি পণ্য। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর যতটা না দাম কমেছে, তার চেয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) তথ্যেও এর প্রমাণ মিলেছে।

টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চালের দাম ১.৮৭ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ১২.১২ শতাংশ, ফার্মের ডিম ৫.৭১ শতাংশ ও মুগ ডাল ৯.৬৮ শতাংশ বেড়েছে। বাড়তি অন্যান্য পণ্যের দামের হারও।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মাছ-মাংস, ডাল-চাল, মসলা ও সবজি মিলিয়ে একদিনের বাজারের খরচ হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল কিনতে ৫০-৫৪ টাকা, পাঙাশ বা তেলাপিয়া ২৪০-২৯০ টাকা, আলু ৬০ টাকা, পেঁয়াজ ১১৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২৪০ টাকা, মরিচ (৫০০ গ্রাম) ১৫০ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১০৫-১১০ টাকা ও তেল (খোলা) ১৬০ টাকা। এতেই যে কোনো পরিবারের বাজার খরচ দাঁড়ায় হাজার টাকার বেশি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতি বন্যা-বৃষ্টি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতায় বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার জানান, সম্প্রতি বন্যায় ও টানা বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বাজারে কমেছে সরবরাহ। তাছাড়া শীতকালীন আগাম সবজি মাত্র বাজারে উঠতে শুরু করেছে যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তাই দামও তুলনামূলক বাড়তি।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ বলেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানি ও ধরা বন্ধের খবরে বাড়ছে দাম। ইলিশের প্রভাবে বেড়েছে অন্যান্য মাছের দামও। এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় অসংখ্য মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমার প্রভাব তো রয়েছেই।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে সিন্ডিকেট করে ডিম-মুরগির দাম বাড়ানো হয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকার সব সময় করপোরেটদের সঙ্গে নিয়ে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণের আলোচনা করেন, এখানে প্রান্তিক খামারিদেরও মতামত নিতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানির ফিড ও মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ কমে আসবে। বাজারেও দাম কমে যাবে। প্রান্তিক খামারিরাও ন্যায্য মূল্য পাবে, ভোক্তারাও ন্যায্যমূল্যে ডিম-মুরগি কিনতে পারবেন।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ঊর্ধ্বমুখী বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাঁধা আয়ের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের। বাজার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে মানুষের কষ্ট আর বাড়বে।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। এটি গত সরকারের সময় থেকেই বাড়তি। সরকার পতনের পর মাঝে এক সপ্তাহ দাম কমলেও এখন আবার সেটি চড়া। কারণ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। তারা আগের মতোই কারসাজি করে যাচ্ছেন। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ব্যাগভর্তি বাজার করা কষ্টসাধ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে ৫০০ টাকায়ও ব্যাগভর্তি বাজার করা যেত। বর্তমানে বাড়তে বাড়তে সেটি হাজার টাকার বেশি ছাড়িয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকায়ও ব্যাগ ভর্তি বাজার করা সম্ভব হয় না।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে জোরালোভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাব সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে। কিন্তু বাজারে এখনো বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যের দাম চড়া।

অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাজারে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছিল। তবে হঠাৎ করেই বাজার পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। সরকারের উচিত কঠোর নজরদারি করা ও নীতিকৌশল নির্ধারণ করা।

বিবিএসের পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে মাহফুজ কবির জানান, বিবিএস গড় পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এটি না করে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম আলাদা প্রকাশ করা যেতে পারে। তাহলে মানুষের কাছে বাজার পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে