বিদেশ থেকে নেওয়া বাংলাদেশের ঋণ আবারও শত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে; জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৪ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে মোট বিদেশি ঋণ ছাড়িয়েছিল ১০০ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ বাড়লে তা কমে হয়েছিল ৯৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বুধবার প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে বিদেশ থেকে নেওয়া সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী দেশীয় মুদ্রায় যা ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)।
এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ৮৩ দশমিক ২১৫ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতের কোম্পানির বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২০ দশমিক ৫৭৪ বিলিয়ন ডলার।
বড় বড় প্রকল্প ও অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন কাজে হাত দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান। এর আগের ছয় মাসে ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাড়ে ১৫ বছরে সরকার প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলার ঋণ করে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেওয়ার বছর শেষে (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা যথাযথ না থাকায় দেশি ও বিদেশি উভয় উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ নেওয়াকে সবসময় স্বাগত জানান অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। এসব ঋণের একটা অংশ দর কষাকষি বা কম বাছবিচার করে নেওয়ার সমালোচনাও রয়েছে। শেষের দিকে উন্নয়ন কাজের চাপ সামাল দিতে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ার বিষয় নিয়েও সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকরা।
বেশি বেশি বিদেশি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি ঋণ বেড়ে গেলে কিছুটা তো ঝুঁকি বেড়ে যায় দেশের। বর্তমান ঋণ স্থিতি আমাদের মতো দেশের জন্য অধিক বেশি ঋণ হয়ে গেছে। যদিও এসব ঋণ নেওয়া হয়েছিল বড় বড় প্রকল্পের জন্য। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আগের সরকার ঠিকমত পরিকল্পনা করেছে কি-না তা জানা নেই। এমনিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা না বাড়লে তো ঋণ পরিশোধে সমস্যা হবে। তাই রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।’
২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এ মেয়াদে (২০১৪-২০১৮ সাল) দ্রæত হারে বেড়েছে বিদেশি ঋণ। আগের পাঁচ বছরের চেয়ে ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বা ১৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ২০১৮ সাল শেষে স্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকারে থাকার সময়ে (২০১৯-২০২৩) বৈদেশিক ঋণ বাড়ে সবচেয়ে বেশি। এ সময় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৯ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
আগের পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বাড়ে ৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার যা এক বছরের হিসাবে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পরের বছর তা ছাড়িয়ে যায় আগের হিসাবকে। ঋণ ছাড়ে গতিও আসে সে বছর। ২০২১ সালে মোট ঋণ নেওয়া হয় ৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার যা বছরওয়ারি হিসাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
যাযাদি/ এসএম