মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

বন্ধ হচ্ছে ইলিশ রপ্তানি দেশে কমতে পারে দাম  

আলতাব হোসেন
  ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৪৯
ছবি : যায়যায়দিন

মাছের রাজা ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ। এরপরও দেশের বাজারে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয় ইলিশ। এবার কম দামে বাঙালির পাতে বড় সাইজের ইলিশ তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। স্বল্প আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ইলিশ মাছের দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। রপ্তানি বন্ধ হলে এবার কিছুটা কম দামেই স্বাদের ইলিশ খেতে স্বপ্ন দেখছেন অনেকে।

এদিকে, উপকূলে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ। ট্রলার বোঝাই ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছে জেলেরা। কাক্সিক্ষত ইলিশ পেয়ে খুশি জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ইলিশে সয়লাব হয়ে পড়েছে বাজার। দক্ষিণের সব ইলিশের মোকামে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। রাজধানীর বাজারগুলোতে চোখে পড়ে ইলিশ নিয়ে হাঁকডাক। কারওয়ানবাজার, সোয়ারীঘাট, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, বাড্ডার মাছের আড়তে ইলিশ আর ইলিশ। ভোর থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে ব্যস্ত কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত। সারি সারি ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে কার্টন ভর্তি ইলিশ মাছ। ঢাকার সোয়ারীঘাট, যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজার হয়ে উঠেছে ইলিশের বড় মোকাম।

সোমবার রাজধানীর মিরপুর, নিউমার্কেট, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী ও কারওয়ান বাজারে এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ২৫শ’ থেকে ২৭শ’ টাকা দরে। দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৪ হাজার টাকা, ফ্রিজে রাখা এক কেজি সাইজের ইলিশ ২ হাজার ২শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়। ৯০০ গ্রামের ইলিশ ১৪৫০ টাকা ও ৬০০শ’ থেকে ৭০০শ’ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হয় ১১৫০ টাকায়। বাজারে প্রচুর ইলিশ। বিভিন্ন সাইজের ইলিশের সমারোহ চলছে এখন দেশের মাছ বাজারগুলোয়। এ বছর ১৫০ গ্রাম ওজন থেকে শুরু করে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ দেখা যাচ্ছে বাজারে। কিন্তু ক্রেতাদের অভিযোগ, সরবরাহ বাড়লেও দাম এখনও বেশি।

সোমবার সন্ধ্যায় মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারে মাছ কিনতে আসেন ব্যাংকার শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, ‘ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। পটল দিয়ে ইলিশের ঝোল খেতে পরিবারের সবাই চাপ দিচ্ছে। এক কেজি ২শ’ গ্রামের ইলিশ ২ হাজার ২শ’ টাকায় কিনেছি। এখন পটল কিনে বাড়ি যাচ্ছি।’

কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা আজাহার দেড় কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম আড়াই হাজার টাকা হাঁকছেন। তিনি বলছেন, এটা পদ্মার তাজা ইলিশ। পেটে ডিম নেই। এই ইলিশ ফ্রিজে রাখা নয়, এটা টাটকা ইলিশ স্বাদ বেশি।

এদিকে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার পরও মাছ বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। মিরপুর কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী বরকত মিয়া বলেন, মোকামে এখনো চড়া দাম। তাই খুচরা পর্যায়েও দাম বেশি।

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে ইলিশ কিনতে আসেন এনজিও কর্মী আবুল আসাদ। তিনি বলেন, ‘সরকারের ঘোষণা শুনে মনে হয়েছিল এখন ইলিশের দাম কমবে। এর আগেও সেনা সমর্থিত সরকার ২০০৭ সালে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে। তখন এক কেজি ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনেছি। এবার সরকারের ইলিশ রপ্তানি বন্ধ হতে পারে এ খবর টিভিতে দেখে বাজারে এসে হতাশ হলাম। একটু বড় সাইজের ইলিশ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।’

একই বাজারে কথা হয় মাছ বিক্রেতা হালিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মোকামে এখনও ইলিশের দাম বেশি, তাই খুচরা বাজারে ইলিশের দাম বেশি। তবে বাজারে ইলিশের ক্রেতা বেশি আসছেন। না বুঝে অনেকেই বরফ দেওয়া পুরনো ইলিশ কিনে নিচ্ছেন। আবার কেই পেটে ডিমভর্তি ইলিশ কিনে ঠকে যাচ্ছেন। কারণ ডিমওয়ালা ইলিশে স্বাদ কম হয়।

এবার সাগর থেকে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ বাড়ায় পটুয়াখালী উপকূলের কুয়াকাটা, মহিপুর, আলীপুর, খালগোড়া এলাকার আড়তগুলো কেনাবেচা জমে উঠেছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের মোকাম হিসেবে পরিচিত মহিপুর ও আলীপুর মৎস্য বন্দরের আড়তগুলোতে মাছ আসছে বেশি।

মঙ্গলবার পটুয়াখালীর বড় দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আলীপুর ও মহিপুর সকালের বাজারে দেখা গেছে, বিভিন্ন আড়তগুলোতে স্থানীয়রা ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, হাতিয়া, পাথরঘাটাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে ট্রলার নিয়ে মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ায় সরগরম পুরো মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। বিভিন্ন সাইজের ইলিশের ক্রয়-বিক্রয় এবং হাঁকডাকে পুরো বাজার ছেয়ে গেছে।

আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের শাহেদ ফিসের পরিচালক আব্দুল হাই খন্দকার বলেন, গভীর সমুদ্রে জেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নিয়ে আসছে এবং ভালো দামও পাচ্ছে। আজকের জাটকা প্রতি মণ ২১ হাজার টাকা, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ ২৮ হাজার, ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশ ৩৬ হাজার এবং ১ কেজির উপরের ইলিশ ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এফবি সুলতানা ট্রলারের মাঝি হারুণ আলী বলেন, ‘ভালো মাছ পেয়েছি। মাছ নিয়ে আলিপুর মৎস্য বন্দরে বিক্রি করতে এসেছি। যা মাছ পেয়েছি তা ১১ লাখ টাকার মতো বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’

সাগর থেকে ফিরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার এফবি আল্লাহর দান ট্রলারের মাঝি কাদের বলেন, ‘এবার ইলিশ ভালোই ধরা পড়তেছে। কেউই খালি হাতে ফিরছে না। ইলিশের সাইজও বাড়ছে। তয় এখন ছোট-বড় সব সাইজের ইলিশই ধরা পড়ছে।’ তার জালে প্রায় ৪৮ মণ ইলিশ ধরা পড়ে। সাড়ে ৮শ’ গ্রাম থেকে এক কেজি দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে বেশি। ছোট আকারের ইলিশও ধরা পড়েছে তার জালে। তিনি ৪৮ মণ ইলিশ ডাকে ২১ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন।

ইলিশ রপ্তানিকারক মণ্ডল মৎস্য ভাণ্ডারের পরিচালক আব্দুল আহাদ মণ্ডল বলেন, প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও দুর্গাপূজার আগে বড় ইলিশের দাম বৃদ্ধি পায়। গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। আবার বৈশাখে উপহার হিসেবে অনেক দেশে বড় সাইজের ইলিশ পাঠানো হয়। এ কারণে মৌসুমেও ইলিশের দাম বেশি থাকে। প্রতি বছর ৩ হাজার টনের বেশি ইলিশ রপ্তানি হয়।

উল্লেখ্য, ইলিশ নোনা পানির মাছ। ডিম পাড়ার মৌসুমে সাগরের উজানের দিকে আসে ইলিশ। ফলে দেশের বৃহৎ নদীসমূহ যথা পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ইত্যাদি নদীতে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। ইলিশ আছে-বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। বঙ্গোপসাগর তীরের ভারত-মিয়ানমার, আরব সাগরতীরের বাহরাইন-কুয়েত, পশ্চিম-মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া, চীন সাগরের পাশে চীন ও থাইল্যান্ডে ইলিশের বিচরণ কমছে। আর বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ৮ শতাংশ, মিয়ানমারে ৩ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ ধরা পড়ে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। এর মধ্যে প্রতি বছর ৩ হাজার টনের বেশি ইলিশ রপ্তানি হয়। ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৪১ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হয়। এতে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৩৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে।

বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ডফিস বাংলাদেশ যৌথভাবে ইলিশের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও গতিবিধি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। বিশ্বব্যাপী এই রুপালি ইলিশের কদর রয়েছে। পাশের দেশেও বাংলাদেশের ইলিশের কদর অনেক।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে