ঈদ ঘিরে চাঙ্গা অর্থনীতি
প্রকাশ | ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩৯
ঈদ সামনে রেখে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি। বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এক্ষেত্রে অর্থের বড় জোগান আসছে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজার, জাকাত ও ফিতরা থেকে। এ ছাড়াও অর্থের অন্যতম একটি উৎস রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) বেশখানিকটা বেড়েছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা ছুটছেন গ্রামে। তাদের ঈদ শুভেচ্ছা ও সাহায্য-সহযোগিতার অর্থে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে বড় ঢেউ লেগেছে।
ঈদের অর্থনীতি নিয়ে সরকারিভাবে এখনো কোনো গবেষণা না হলেও বেসরকারি গবেষণা অনুসারে ঈদ, রমজান ও বৈশাখী উৎসব ঘিরে অর্থনীতিতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হবে। এ টাকার বড় অংশই যাবে গ্রামে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভোগবিলাস খাতেই বেশিরভাগ টাকা যাচ্ছে। তবে কিছু অংশ যাচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ডক্টর এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রমজান ও ঈদের মতো উৎসব এলেই বাড়তি টাকার প্রবাহে সচল হয়ে উঠে গ্রামের অর্থনীতি। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকা যাচ্ছে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। এটি ইতিবাচক দিক। তবে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এজন্য ঈদের পর ওই টাকা উৎপাদন খাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ থাকা জরুরি।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিনের হিসাবে জাকাত ও ফিতরার প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা, তৈরি পোশাকের ৩৫ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্যের বাজার ২৫ হাজার কোটি এবং ঈদ বোনাস, পরিবহণ ও অন্যান্য মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়। এ ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু অংশ ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়ে থাকে।
ঈদ ও বৈশাখী উৎসবকেন্দ্রিক সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজারে। এ দুটি উৎসব ঘিরে সব শ্রেণির মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক কেনাকাটা করে। তাই ঈদ ও বৈশাখী অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে পোশাকের বাজার। এবারও ১৫ রোজা পার না হতেই দোকানগুলোয় পোশাকের বেচাকেনা তিন থেকে চারগুণ
বেড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ পোশাকের সবচেয়ে বড় জোগান আসছে পুরান ঢাকার উর্দু রোডের অভ্যন্তরীণ পোশাক মার্কেট থেকে। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের বিভাগীয়, জেলাসহ মফস্বল মার্কেটগুলোয় দেশি পোশাক সরবরাহ হচ্ছে এখান থেকে। দেশের বুটিক ও ফ্যাশন হাউসগুলোতেও বেচাবিক্রি জমে উঠেছে আশানুরূপভাবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'ঈদ সামনে রেখে চলতি বছর আমাদের দোকানগুলোর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। আশা করি, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। সামগ্রিকভাবে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো। আরও সপ্তাহ খানেক পেরোলে পুরোটা বোঝা যাবে।'
এদিকে ঈদ ঘিরে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা এরই মধ্যে কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, ডাল, সেমাই এবং পেঁয়াজের চাহিদা উলেস্নখযোগ্য হারে ঊর্ধ্বমুখী। এসব পণ্যের আমদানিও বেড়েছে।
বরাবরের মতো এ বছরও সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী অষ্টম বেতন কাঠামোর আলোকে ঈদ বোনাস পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব কাঠামোতে বোনাস দিচ্ছে। এছাড়া পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রায় ৭০ লাখ কর্মীও বোনাস পাচ্ছেন। যার পুরোটাই যোগ হচ্ছে ঈদ অর্থনীতিতে।
ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে সারা দেশের দোকান কর্মচারীদের বোনাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ২০ লাখ দোকান, শপিংমল, বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে ৩ জন করে ৬০ লাখ জনবল কাজ করছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে একজন কর্মীকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে বোনাস ৮ হাজার টাকা ধরে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বোনাস পাচ্ছে এ খাতের শ্রমিকরা যা পুরোটাই ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ডক্টর এমকে মুজেরী বলেন, 'ঈদে টাকার প্রবাহ বাড়ে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ টাকা পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা ও ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতে বেশি ব্যয় হচ্ছে। কাজেই এটা একটা বড় ভূমিকা রাখে অর্থনীতিতে।' তিনি আরও বলেন, 'উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।'
এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই শেষ ঈদ হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য-সহযোগিতা ও দানের তৎপরতা বাড়ায় ঈদ অর্থনীতিতে এর জোরাল প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঈদ শুভেচ্ছায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতারা কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন। আবার অনেক নতুন মুখ রাজনীতিতে পরিচিত হওয়ার জন্য ঈদ শুভেচ্ছায় অঢেল টাকা ব্যয় করেন। এছাড়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গরিব, দুস্থ, এতিমদের পাশে দাঁড়ান তারা। জাকাতের কাপড় বিতরণের ধুম পড়ে যায়।
এদিকে ঈদ ও বৈশাখী উৎসবকে ঘিরে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় পণ্য উৎপাদনের ধুম পড়েছে। তাদের তৈরি পণ্যে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ির দেশব্যাপী চাহিদা থাকায় ওই এলাকায় তাঁত মালিক ও তাঁতীদের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের লুঙ্গি ও তাঁতের কাপড় সারা দেশে ব্যাপকভাবে চলছে। মুন্সীগঞ্জের রুহিতপুরী তাঁতের কাপড়ের চাহিদাও তুঙ্গে। গাজীপুরের কালীগঞ্জের টাওয়ালের চাহিদাও ব্যাপক। নরসিংদীর বাবুরহাটে ক্রেতার চাপ সামলাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতের পাইকারি বাজারেও। রূপগঞ্জের রূপসীর জামদানি শাড়ি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। তাঁতের তৈরি কাপড়ের চাহিদা বাড়ায় ঢাকাকেন্দ্রিক ফ্যাশন হাউস ও বস্ত্র ব্যবসায়ীরা এখন তাঁতীদের কাছ থেকে কাপড় সংগ্রহ করেছেন। এসব মিলে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোও বেশ জমজমাট ব্যবসা করছে।
ঈদে প্রতি বছরই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। বাড়তি খরচের জন্য প্রবাসীরা তাদের স্বজনদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ পাঠায়। এর বড় অংশই যাচ্ছে গ্রামে। এদিকে চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ৪৭ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) ৫ হাজার ১০২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ৯ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স প্রবাহ মার্চ মাসে ২০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। গত বছরের আগস্টের পর, এই প্রথম দুইশ' কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। মার্চ মাসে ২০২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। ফেব্রম্নয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ১৫৬ কোটি ডলার। মার্চের প্রবাহ আগের মাসের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ঈদ পর্যন্ত এটা অনেক বাড়বে। কারণ স্বাভাবিকভাবে প্রতি বছরই ঈদের মাসে রেমিট্যান্স বাড়ে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর হিসাবে প্রতি বছর জাকাত ও ফিতরা বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে গ্রামে। এছাড়া রোজা ও ঈদে নানা কর্মসূচিতে শহরের চাকরিজীবীরা গ্রামে যাচ্ছেন। সেখানে তারা অর্থ ব্যয় করছেন। যে কারণে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এছাড়া গ্রামের দরিদ্র মানুষের সহায়তায় শহরের লোকজন সাধ্য অনুযায়ী অর্থের জোগান দিচ্ছেন।
ঈদের অর্থনীতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, 'ঈদকেন্দ্রিক বেচাবিক্রি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু করোনার কারণে গত তিন বছরে ঈদের অর্থনীতিতে অস্বস্তি ছিল। এ বছর প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন। তবে বৈশ্বিক সংকটের কারণে এবার সব ধরনের পণ্যের দাম একটু বাড়বে। এরপরও মানুষ কেনাকাটা করবেন বলে আশা করছি।' এর অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরবে বলে আশাবাদী তিনি।
এদিকে ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু তাই নয়, আগামী তিন মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। রোজার ঈদের পরই শুরু হবে কোরবানি ঈদের প্রস্তুতি। সেই সময়ও প্রবাসীরা বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠাবেন। ফলে ডলার সংকট কেটে বাড়বে রিজার্ভ। দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাড়াতে হলে এখন ডলারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ঈদকে ঘিরে সেই ডলার সংকট কাটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যবসায়ীরা সারা বছর এই সময়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে ঈদকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বিনিয়োগ করছেন। করোনার কারণে বিধিনিষেধের মুখে গত তিন বছর ব্যবসায়ীরা সেভাবে মুনাফা করতে না পারলেও এবার তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা করছি। ইতোমধ্যে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে পাইকারি মার্কেটের পর এখন খুচরা পর্যায় থেকে ভোক্তারা সাধ্যমতো কেনাকাটা করছেন। তিনি বলেন, 'ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ অনেক বাড়াচ্ছেন। ফলে রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য যখন চাপের মুখে তখন ঈদের কারণে আমরা ডলার পাচ্ছি। এটা সবচেয়ে ভালো দিক।'
যাযাদি/ এসএম