এসেছে অগ্রহায়ণ পিঠা-পুলির মাস
প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৭
মধ্য হেমন্তের শিশিরভেজা প্রকৃতি জানান দেয় শীত আসছে। বছর ঘুরে বাঙালির কৃষিসমাজে আবারও এসেছে আয়োজনের উপলক্ষ। বাংলার আদিগন্ত মাঠ জুড়ে এখন হলুদে-সবুজে একাকার নয়নাভিরাম অপরূপ প্রকৃতি। সোনালি ধানের প্রাচুর্য। আনন্দধারায় ভাসছে কৃষকের মনপ্রাণ। বাড়ির উঠান ভরে উঠবে নতুন ধানের ম ম গন্ধে। বাঙালির প্রধান অন্ন আমন ধান কাটার সময়। বাংলা পঞ্জিকার নিয়ম অনুযায়ী, আজ ১ অগ্রহায়ণ। অনেক পালাবদলেও বাঙালির নবান্ন পুরোপুরি মলিন হয়নি। আবহমান বাংলার অন্যতম উৎসব এটি।
কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরো ভাগে থাকা এই নবান্ন উৎসব অনাদিকাল থেকে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উৎসব। হিন্দু লোককথায় এদিনকে বলা হয়ে থাকে বার্ষিক মাঙ্গলিক দিন। নতুন আমন চালের ভাত বিবিধ ব্যঞ্জনে আহার ও পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে জনপদ। মেয়েকে নাইয়র আনা হয় বাপের বাড়ি। নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে কোথাও কোথাও দোয়া, মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। হিন্দু কৃষকের ঘরে ঘরে ধুমধামে চলে পূজার আয়োজন। হিন্দুদের বারোমাসের তেরো পার্বণের বড় পার্বণ হলো এই নবান্ন। এই নবান্নকে ঘিরে তাদের বারো পূজার প্রচলন আছে। তারা নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক প্রভৃতি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবার সদস্যরা নতুন গুড়সহ নবান্ন গ্রহণ করেন। হিন্দু লোকবিশ্বাসে কাকের মাধ্যমে ঐ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলি’।
বাংলাদেশে যেসব উৎসব হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রচলিত নবান্ন উৎসব। হেমন্তে ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন অর্থ- নতুন অন্ন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। আমাদের দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল ঘরে তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে ডেকে খাওয়ানো হয়।
তথ্য বলছে, অগ্রহায়ণ ‘ফসলি’ নামের সনটা প্রথম আধুনিকীকরণ করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাসদ ‘ফাতেউল্লাহ’। তবে অনেক গবেষকের মতে, সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনকে আধুনিকীকরণের আগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থটাও অনেকটা তা-ই দাঁড়ায়।
মোগল আমলে কর তোলার সুবিধার কথা বিবেচনা করে বৈশাখ মাসকে বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কারণ, তৎকালীন কৃষকের বার্ষিক উৎপাদিত ফসলের কর তোলার সুবিধাজনক সময় ছিল বৈশাখ মাস। খটখটে শুকনা এ মৌসুমে ঘোড়ায় চড়ে যেকোনো কৃষকের বাড়িতে হানা দিয়ে কর আদায়ে সুবিধা পাওয়া যেত।
এ তো গেল পুরানো আমলের কথা। কালে কালে কৃষকদের আনন্দের সময় এই অগ্রহায়ণ মাস। কারণ, এ সময় তাদের ঘরে নতুন ফসল আসে, আসে সমৃদ্ধি।
তবে অতীতের সেই সমৃদ্ধি এখনকার কৃষকদের আর নেই। কখনো বন্যা, কখনো খরা-অতিবৃষ্টি-নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগী, সরকারি উদাসীনতা- এসব নানা কারণে কৃষকরা ফসল উৎপাদনের প্রকৃত সুফল পাচ্ছেন না। শিল্পবিপ্লবের এই দাসত্বের যুগে কৃষি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।
এরপরও অগ্রহায়ণের হালকা শীতের আমেজ, পদতলে শিশিরের স্নিগ্ধ পরশ, ধূসর প্রকৃতি, ফসলশূন্য ধু ধু মাঠ, মন্থর সন্ধ্যা ও শিউলি ফুলের সুবাসে বাঙালির মন ভরে থাকে। মধ্যরাতে আকাশে দেখা মেলে ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমণ্ডলীসহ অসংখ্য জ্বলজ্বলে নক্ষত্র।
হেমন্ত ঋতু নিয়ে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা। এর মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ অনবদ্য। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উঠে আসে-‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে।’
রামপ্রসাদ সেন বলেছেন, ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না/এমন মানব জমিন রইলো পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা।’
আমাদের উপমহাদেশের গণসংগীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ সুরকার ও শিল্পী সলিল চৌধুরী গেয়েছেন, ‘হেই সামালো, হেই সামালো ধান হো/কাস্তেটা দাও শাণ হো/জান কবুল আর মান কবুল/আর দেবো না, আর দেবো না/রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কবিতায় আহ্বান জানান, ‘হে শীতের সূর্য! হে শীতের সূর্য!/হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়/আমরা থাকি/যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ/ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্য।’
নবান্ন ঘিরে যুগে যুগে কালে কালে অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে সারা দেশে। এখনো অনেক জায়গায় নবান্ন উপলক্ষে মেলা বসে। নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, লাঠিখেলা, বাউল গান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খই, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেসব অনেকটাই হারাতে বসেছে। তারপরও যতটুকুই পালিত হয়, তা বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে জাগিয়ে রাখে।
যাযাদি/ এস