হেরিনু শারদ প্রভাতে
প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৩৯
‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।’- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতুচক্রের মধ্যে শরৎ ঋতুর শুভ্রতার বর্ণনা দিতে গিয়ে এমনই পঙ্ক্তি সাজিয়েছেন। প্রকৃতিতে রূপের ডালি সাজিয়ে হাজির হওয়া শরৎকালের নির্মল কোমল প্রশান্তÍ স্বভাবের মোহময় রূপটির সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। শ্রাবণের মেঘভাঙা জল থই থই বিষণ্নতা পেরিয়ে প্রতি বছর শরৎ আসে বাংলার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতিতে পালাবদলের গান নিয়ে। আজ পহেলা ভাদ্র। শুরু হলো ঋতুরাণী শরতের প্রথম দিন।
বাংলা সাহিত্যে এই ঋতুর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যে শরৎ বন্দনায় বলেছেন-‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন-‘আকাশ ফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূরাতো শরৎকালে আসে।’ কবির কল্পনায় শরৎ ঋতুর সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর উপমা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় নেই। শরতে প্রকৃতি যেন সত্যিই নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে।
‘শরতের রংটি প্রাণের রং’ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শরৎ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘শরতের রংটি প্রাণের রং। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড়ো নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা। এজন্য শরৎ নাড়া দেয় আমাদের প্রাণকে, যেমন বর্ষায় নাড়া দেয় আমাদের ভিতর-মহলের হৃদয়কে, যেমন বসন্তে নাড়া দেয় আমাদের বাহির মহলের যৌবনকে।’ রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভেতরের মহলে লুকিয়ে থাকা সব কথা কী করে যেন জানতে পারেন! শরতের প্রকৃতি নিয়ে তাঁর এমন গভীর পর্যবেক্ষণ, এমন সত্য উচ্চারণ, সমকালীন সাহিত্যে সত্যিই বিরল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতা-গানে শরতে বাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপের বর্ণনা করেছেন। ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’-সহ অনেক গান তিনি রচনা করেছেন।
‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন-‘কুমারীর ভীরু বেদনা-বিধুর প্রণয় অশ্রুসম/ঝরিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি-ভোরে অনুপম।’ অন্যত্র আছে-‘কাশফুলসম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে/তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।’ নজরুলের এই কবিতায় শরতের প্রায় সব অনুষঙ্গই বর্ণিত হয়েছে। কাশ-শিউলির শুভ্রতায় মোড়ানো ভোরের মিষ্টতা, শিশিরস্নাত ফুলদলের মোহনীয়তা কিংবা শরতের বৈভব, অনুভবও।
দৃশ্যত গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরৎ আসে সাড়ম্বরে। শরতের মেঘহীন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা প্রকৃতি প্রেমিকদের মন কেড়ে নেয়। শরতের শেফালি, মালতী, কামিনী, জুঁই, টগর আর সাদা সাদা কাশফুল মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় সৌন্দর্য। শেফালি মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। যদিও ইট-কাঠের নগরীতে শরৎ থেকে যায় অনেকটা আড়ালে। শরতেই হয়ে থাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সত্যিকার অর্থে, শরতের রূপ শান্ত-স্নিগ্ধ ও কোমল। যেখানে আছে নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস।
জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, ‘যৌবন বিকশিত হয় শরতের আকাশে’। তিনি প্রিয়তমাকে খুঁজে ফেরেন শরতের ভোরের স্নিগ্ধতায়। ‘ঝরা পালক’ গ্রন্থের ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে/বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,/মালতীলতার বনে,-কদমের তলে,/নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,-শেফালীর দলে!/Ñযাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে’।
শরতের রূপ-লাবণ্য কবির হৃদয়ানুভূতিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। সৃষ্টিশীল কবির হাত ধরে শরৎ উঠে আসে কবিতায়, কবির পঙ্ক্তিমালা হয়ে যায় শরৎসমৃদ্ধ।
বৈষ্ণব সাহিত্যে শরতের সৌন্দর্য, বিরহের রূপ প্রতিটি মানুষের মনকে উদ্বেল করে তোলে। বৈষ্ণব পদাবলির অন্যতম কবি বিদ্যাপতি রাধা বিরহের যে চিত্র এঁকেছেন তা শুনে প্রতিটি বিরহ কাতর হৃদয়েই হাহাকার ওঠে-‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’
ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে বাংলা সনের ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। সদ্যবিদায়ী শ্রাবণধারা পত্রপল্লবের গায়ে যে উজ্জ্বলতার রং এঁকে দেয়, শরতে তা আরও নিখাদ হয়ে ওঠে।
শরতের এই রং রূপ গন্ধ শোভা ঐশ্বর্য- সবই যেন অলৌকিক সৌন্দর্যের আধার। শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতি, স্বচ্ছ নীলাকাশ দুপুরের আলোমাখা সোনা রং, বিকালের নরম রোদে পুকুর ঘাটে কিশোরীর পা ডুবানো দৃশ্য, সন্ধ্যার হাত ধরে কুয়াশার বিস্তৃতি মনে করিয়ে দেয় শরতের চিরন্তন ও শাশ্বত রূপ।
যাযাদি/এস