রোববার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১

রাজীব-সোনিয়ার প্রেম কাহিনী

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
  ২৭ মে ২০২৪, ১৩:৪৪
আপডেট  : ২৭ মে ২০২৪, ১৩:৪৭
-ফাইল ছবি

সময়টা ছিল ১৯৮১ সালের মে মাস। এবারের মতো তখন ভারতে তুমুল নির্বাচনী প্রচারণা। অবশ্য তখন ছিল সব কিছু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দখল। এখন তো কংগ্রেসের অবস্থা নাজুক। সে সময় কংগ্রেসের নেতা ছিরেন প্রয়াত রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধী আমেঠি থেকে লোকসভার উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছেন। নিজের নির্বাচনী এলাকায় ঘুরছিলেন তিনি। কয়েক ঘণ্টা পর তাকে লখনউ থেকে দিল্লির বিমান ধরতে হবে। কিন্তু তখনই খবর এল যে ২০ কিলোমিটার দূরে তিলোইতে ৩০-৪০টি বস্তিতে আগুন লেগে গেছে।

লখনউ যাওয়ার পরিবর্তে তিনি তিলোইয়ের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি পুড়ে যাওয়া বস্তিতে বসবাসরত মানুষকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তখনই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সঞ্জয় সিং তার কানে ফিসফিস করে বললেন, "স্যার, আপনি আপনার ফ্লাইট মিস করবেন।"

কিন্তু রাজীব গান্ধী মানুষের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে থাকেন। সবার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পরে তিনি হাসিমুখে সঞ্জয় সিংকে জিজ্ঞেস করলেন, এখান থেকে লখনউ পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে?”

‘দ্য লোটাস ইয়ার্স - পলিটিকাল লাইফ ইন ইন্ডিয়া ইন দ্য টাইম অফ রাজীব গান্ধী’র লেখক অশ্বিনী ভাটনগর ব্যাখ্যা করেছেন, "কমপক্ষে দুই ঘণ্টা," সঞ্জয় সিং উত্তর দিয়েছিলেন।

"কিন্তু আপনি যদি স্টিয়ারিং হাতে নেন, আমরা এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো।"

গাড়িতে বসেই রাজীব গান্ধী বললেন, “ওখানে খবর পাঠিয়ে দিন যে আমরা এক ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মধ্যে আমৌসি বিমানবন্দরে পৌঁছে যাবো। রাজীব গান্ধীর গাড়ি যেন মহাকাশ যানের মতো চলতে শুরু করলো। নির্ধারিত সময়ের আগেই রাজীব গান্ধী বিমানবন্দরে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন।“

পাইলট ছিলেন রাজীব গান্ধী

দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর শখ ছিল যে রাজীব গান্ধীর, সেই তিনিই কিন্তু অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বিমান চালাতেন। প্রথমে তিনি ডাকোটা চালাতেন কিন্তু পরে বোয়িং চালাতে শুরু করেন। যখনই তিনি পাইলটের আসনে থাকতেন, ককপিট থেকে শুধুমাত্র নিজের নামটুকুই বলে যাত্রীদের অভিবাদন জানাতেন।

ফ্লাইটের সময় তার পুরো নাম প্রকাশ না করার জন্য তার ক্যাপ্টেনদেরও নির্দেশ দেওয়া ছিল।

তখনকার দিনে তিনি পাইলট হিসেবে বেতন পেতেন পাঁচ হাজার টাকা, যা সেই সময়ে বেশ ভালো বেতন হিসেবেই বিবেচিত হতো।

রাজীব-সোনিয়া প্রেম

রাজীব গান্ধী যখন কেমব্রিজে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ট্রাইপোস কোর্স করতে যান, তখন, ১৯৬৫ সালে সোনিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয়। ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী সোনিয়ার সঙ্গে বলতে গেলে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যান রাজীব গান্ধী। তারা দুজনেই একটি গ্রীক রেস্তোরাঁয় যেতেন।

অশ্বিনী ভাটনগর লিখেছেন, "রাজীব রেস্তোরাঁর মালিক চার্লস অ্যান্টনিকে সোনিয়ার পাশের টেবিলে বসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য খুব করে ধরেছিলেন। একজন প্রকৃত গ্রিক ব্যবসায়ীর মতো চার্লস এজন্য তার কাছে দ্বিগুণ অর্থ আদায় করেছিলেন।"

"পরে তিনি রাজীব গান্ধীর উপর সিমি গারেওয়ালের একটি সিনেমায় বলেছিলেন যে 'আমি এর আগে কাউকে এত গভীর প্রেমে পড়তে দেখিনি।' রাজীব যখন কেমব্রিজে পড়াশোনা করছেন, তখন তিনি নিজের খরচ চালানোর জন্য আইসক্রিম বিক্রি করতেন আর সাইকেলে চেপে সোনিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। যদিও তার একটি পুরানো ভক্সওয়াগেন গাড়ি ছিল যার পেট্রোলের খরচ তার বন্ধুরা মিলে ভাগ করে নিতেন।"

সোনিয়ার জন্য কবিতা

বিখ্যাত সাংবাদিক রশিদ কিদওয়াই সোনিয়া গান্ধীর জীবনী-গ্রন্থে কেমব্রিজে থাকাকালীন রাজীব গান্ধী ও সোনিয়ার দেখা করার কাহিনীগুলি উল্লেখ করেছেন।

রশিদ কিদওয়াই লিখছেন, "ভার্সিটি রেস্তোরাঁয় প্রতিদিনই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জমায়েত হত। তারা সবাই বিয়ার খেত। তাদের মধ্যে রাজীবই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিয়ার স্পর্শও করতেন না। সে কারণেই সোনিয়ার নজর পড়েছিল লম্বা, কালো চোখ আর লোভনীয় হাসি দেওয়া একটি নিষ্পাপ ছেলের দিকে।

“দুদিক থেকেই সমান আকর্ষণ ছিল। প্রথমে রাজীব একটি রুমালে তাঁর সৌন্দর্যের উপর একটি কবিতা লিখে ওয়েটারের মাধ্যমে সোনিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সোনিয়া সেটা পেয়ে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু রাজীবের এক জার্মান বন্ধু, যিনি আবার সোনিয়াকেও চিনতেন, তিনি বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করেছিলেন,” লিখেছেন রশিদ কিদওয়াই।

তিনি আরও লিখেছেন, "মজার বিষয় হল রাজীব শেষ পর্যন্ত সোনিয়াকে বলেননি যে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। অনেক দিন পর একটি পত্রিকায় ইন্দিরা গান্ধীর ছবি প্রকাশিত হয়। তখন রাজীব গান্ধী সোনিয়াকে বলেছিলেন যে ওটা তার মায়ের ছবি।“

“সেই সময়ে কেমব্রিজে অধ্যয়নরত একজন ভারতীয় ছাত্র তাকে বলেছিলেন যে ইন্দিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তখনই সোনিয়া প্রথমবারের মতো টের পেলেন যে তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ একজনের সঙ্গে প্রেম করছেন।“

রাজীব-অমিতাভ বন্ধুত্ব

রাজীব গান্ধীর যখন চার বছর বয়স, তখন থেকেই তার সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের বন্ধুত্ব। অমিতাভ যখন মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য লড়াই করছেন তখন একবার রাজীব গান্ধী মুম্বাই গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। অমিতাভ বচ্চন তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কৌতুক অভিনেতা মেহমুদের কাছে।

রশিদ কিদওয়াই লিখেছেন, "তখন মেহমুদের ক্যাম্পোজ (ঘুমের ওষুধ) খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং তিনি সবসময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। অমিতাভ তাকে রাজীবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু নেশা ঘোরে তিনি বুঝতে পারেননি যে তিনি কার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন।"

"তিনি পাঁচ হাজার টাকা বার করে নিজের ভাই আনোয়ারকে বললেন রাজীবকে সেটা দিতে। আনোয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ওকে টাকা দিচ্ছেন কেন? মেহমুদ বলেন, যে ব্যক্তি অমিতাভের সঙ্গে এসেছে সে ওর থেকেও ফর্সা আর স্মার্ট। একদিন ও নিশ্চয়ই একজন আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে উঠবে। তাই আমার পরের ছবিতে সই করার অগ্রিম হিসাবে এই পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি।

“আনোয়ার জোরে হেসে উঠে রাজীবকে আবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যে তিনি স্টার-ফার নন, তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে। মেহমুদ সঙ্গে সঙ্গে তার পাঁচ হাজার টাকা ফেরত নিয়ে রাজীবের কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু রাজীব ভবিষ্যতে একজন তারকাই হয়ে উঠবেন, চলচ্চিত্র তারকা নন, রাজনীতির তারকা,” লিখেছেন মি. কিদওয়াই।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে