শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনুরাগে রঞ্জিত ঠুমরি গান

মোবারক হোসেন খান
  ২৭ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৪৩
মোগলদের হাত থেকে যেদিন ইংরেজরা ছলেবলে-কৌশলে দিল্লির সিংহাসন দখল করে নিল সেদিনই ভারতবর্ষের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভুবনে নেমে এসেছিল তমসা। ইংরেজরা বেনিয়ার জাত। তারা বাণিজ্য বোঝে, সংস্কৃতি বোঝে না, সঙ্গীত বোঝে না। আর সেটা যদি তাদের দৃষ্টিতে বিদেশি সংস্কৃতি ও সঙ্গীত বলে গণ্য হয়। বাণিজ্যের জাঁতাকলে এ দেশের সংস্কৃতি আর সঙ্গীত অমানিশার অতলে নিমজ্জিত হলো। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন খিলজির আমলে যে রাগসঙ্গীত আমির খসরু উদ্ভাবন করেছিলেন এবং তিলে তিলে গড়েছিলেন, অনেক যুগ অতিবাহনের পর ইংরেজের হাতে তার নিধন শুরু হলো।
মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল। যে দিল্লির রাজদরবারে ‘নবরতœ’ সভা এককালে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল, ইংরেজের নিষ্পেষণে সেই নবরতেœর চিহ্ন রইল না। ফলে দিল্লির সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতশিল্পীদের ছোট ছোট রাজা ও নবাবদের দরবারে আশ্রয় নিতে হলো। এমনকি অনেক নবাবকেও ইংরেজরা তাদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিল। তেমনই এক হতভাগ্য ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। তিনি ছিলেন অযোধ্যার শেষ নবাব। ১৮৫৬ সালে ইংরেজরা অযোধ্যা অধিকার করে নেয়। শাসক ওয়াজেদ আলী শাহকে নির্বাসিত করে মেটিয়াবুরুজে। লক্ষেèৗর দরবারের আসর ভেঙে গেল। কিন্তু ওয়াজেদ আলী শাহ সঙ্গীতশিল্পীদের ছাড়েননি। তাদেরও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। লক্ষেèৗ ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি বিদায়ের বেদনা প্রকাশ করে লিখেছিলেন একটি ঠুমরি গান। সে গানে তার হৃদয়ের আর্তি ফুটে উঠেছিল অত্যন্ত গভীরভাবে। তিনি লিখেছিলেন :
বাবুল মোরা নৈহার ছুটহী জায়।
অঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো
ঔর দেহরী ভয়ো বিদেশ
লে বাবুল পিয়া কী দেশ
সঙ্গ চলহী জায়।
চার কহার মিল ভুলিয়া মঙ্গাবে
অপনা বেগানা ছুটহী জায় ॥
(আমার প্রাণের দুলালী পিত্রালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই প্রাঙ্গণ পাথরসম, এই দেশ পরদেশের ন্যায় বোধ হচ্ছে। চারজন বেহারা পালকি নিয়ে এসেছে। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সে পরিত্যাগ করে চলেছে।)
রাগসঙ্গীতের শাস্ত্রকার ও ইতিহাসবিদরা ঠুমরি গীতশৈলীর অন্যতম প্রচলকের কৃতিত্ব ওয়াজেদ আলী শাহর ওপরই অর্পণ করেন। ঠুমরি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পর্যায়ের একপ্রকার লঘু প্রকৃতির গান। ঠুমরি গানের সঙ্গে শৃঙ্গাররস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ গানের বাণীতে শৃঙ্গাররসের চিন্তাধারার অভিব্যক্তি পদে পদে প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে। প্রেমিকের প্রতি প্রেয়সীর প্রেমনিবেদন, বিরহের রূপবর্ণন, মিলনের আকাক্সক্ষা ঠুমরি গানের প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতকলাকার গোলাম নবী সৌরি মিঞা খেয়াল গান থেকে ঠুমরি গানের উদ্ভাবন করেন। পূর্বরাগ, অনুরাগ, মিলন, বিরহ, বিরাগ, বিচ্ছেদ সব বিষয় নিয়ে ঠুমরি রচিত। ঠুমরি গানে প্রীতম, পিয়া, সৈঁয়া, বালম, সঁবরিয়া, সজন ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ ছিলেন কলাপ্রেমিক নবাব। একাধারে তিনি গায়ক, যন্ত্রী, নর্তক, গীত রচয়িতা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ঠুমরি গানের বড় মাপের একজন পৃষ্ঠপোষক ও সংরক্ষক ছিলেন। তিনি ঠুমরি গানের এক ঘরানা প্রবর্তন করেন। এ ঘরানা ‘লক্ষেèৗ ঘরানা’ নামে পরিচিত। এ ঘরানার বৈশিষ্ট্য হলোÑ খেয়ালের লঘু চালের সঙ্গে ‘ভাও’ বা অভিনয়ের ভঙ্গিমা সংযোগ করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। এতে স্বরের একক প্রাধান্যের চেয়ে অলঙ্কারিক স্বর শব্দের প্রয়োগের প্রাধান্য বেশি। গিট্কারী, মুরকী ইত্যাদি অলঙ্কারও বেশি ব্যবহৃত হয়। পরে এ ঘরানার ঠুমরিতে ‘লচাও ভাব’ ও টপ্পা গানের সূক্ষ্ম কাজের প্রচলন করা হয়। ঠুমরি গানে ভাষার মধ্যে নিহিত ভাবার্থের সহজ প্রকাশের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়। এ জন্য এ গান সহজ বোধগম্যরূপে লোকপ্রিয় হয়ে থাকে।
ওয়াজেদ আলী শাহ রাগসঙ্গীতে নিয়মিত তালিম নিয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। বিশিষ্ট সঙ্গীতকার কুতুবদ্দৌলাহর কাছে তিনি ‘সেতার’ যন্ত্রে তালিম নেন। কণ্ঠসঙ্গীতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। নৃত্যকলার প্রতিও তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি নৃত্যগুরু ঠাকুরপ্রসাদের কাছে নৃত্যশিক্ষা লাভ করেন। তিনি দরবারের নৃত্যানুষ্ঠানেও স্বয়ং নৃত্য পরিবেশন করতেন। তিনি কত্থকনৃত্যে ঠুমরির প্রয়োগ ঘটান। তার উদ্যোগেই কত্থকনৃত্যের সঙ্গে গজল গানও যুক্ত হয়। কত্থকনৃত্যের আঙ্গিক বিকাশেও তার অবদান অপরিসীম।
সর্বগুণে গুণান্বিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের কোপদৃষ্টিতে পড়ে অযোধ্যা ত্যাগ করতে হয়েছিল।
ওয়াজেদ আলী শাহ ভারতবর্ষের যেসব রাজন্য দেশ শাসন করেন, সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতপ্রেমিক হিসেবে ছিলেন তাদের অন্যতম। ঠুমরি গানেই তার অবদান সমধিক। তিনি ঠুমরি গানের পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। ওয়াজেদ আলী শাহ রচিত ঠুমরি গানের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গানটি হলো :
যব ছোড় চলে লখ্নী নগরী,
কহুঁ হাল আদম্ র্প ক্যা গুজরী ॥
আদম্ গুজরী সদ্মা গুজরী,
সব হম্ গুজরে, দুনিয়া গুজরী।
(লক্ষ্মৌ নগর ছেড়ে চলে যাচ্ছি যখন,
মানুষের দশা কেমন কি বলব তখন ॥
মানুষ গেল, ঝাঁকি গেল,
আমি যখন গেলাম, পৃথিবীও গেল ॥)
উনবিংশ শতাব্দীতে ঠুমরি গান খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আর ঠুমরি গানের কেন্দ্রভূমি ছিল লক্ষেèৗ। ওখানকার নবাবরা রাজ্য শাসনের চেয়ে গান-বাজনার প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন। আর সঙ্গীতের এমনই একজন অনুরাগী শাসক ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। সঙ্গীতপ্রেমী নবাব হিসেবে তিনি খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন অযোধ্যার শেষ নবাব। ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্য শাসন করেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রতিনিধি দক্ষতার সঙ্গে তার রাজ্য শাসন সুনজরে দেখতে পারেনি। তার রাজ্য শাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। এটা ব্রিটিশদের একটা উদ্দেশ্যমূলক হীনমনোবৃত্তি ছিল। এ দেশের রাজা-বাদশাহদের অদক্ষ ও বিলাসপ্রিয়রূপে প্রমাণিত করে তারা কখনো প্রত্যক্ষভাবে, আবার কখনো পরোক্ষভাবে রাজ্যের শাসনভার দখল করে নিত।
লক্ষেèৗর ক্ষেত্রেও সে ঘটনাই ঘটল। তারা নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে পারদর্শিতার সঙ্গে রাজ্য চালাতে পদে পদে বাধা দিতে লাগল। ফলে নবাব নিরুৎসাহিত হয়ে ওঠেন এবং প্রশাসনের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। তিনি বিলাসী জীবনযাপন শুরু করেন। সঙ্গীতের প্রতি তিনি খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তাই হাতে অঢেল সময় পেয়ে তিনি সঙ্গীতের ভুবনে গা ভাসিয়ে দিলেন।
তিনি রাজ্যে অনেক শিল্প ও বিনোদনের প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। লক্ষেèৗর কাইজারবাগে একটি প্রেক্ষাগৃহে ‘ইন্দ্রসভা’ নামে অপেরা নাটক মঞ্চস্থ হতো। তিনি স্বয়ং এ নাটকে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। নৃত্যশিল্পী নৃত্যানুষ্ঠানেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।
ওয়াজেদ আলী শাহ প্রচুর ঠুমরি রচনা করেন। তিনি তার রচনায় ‘আখতার পিয়া’ বা ‘আলী’ ভনিতা ব্যবহার করতেন। তিনি ‘আখতার’ ছদ্মনামে ‘হুজন-ই-আখতার’ শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক কাব্যগ্রস্থ রচনা করেন। মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত জীবনযাপনে থাকাকালেও সঙ্গীতকে তিনি পরিত্যাগ করেননি। তিনি সেখানে ‘সঙ্গীতসভা’ গড়ে তোলেন। ‘সঙ্গীতসভা’ তৎকালীন বাংলার রাগসঙ্গীত চর্চা ও সাধনাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চায় পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ওয়াজেদ আলী শাহ ও তার ‘সঙ্গীতসভা’ বিপুল অবদান রাখে।
ওয়াজেদ আলী শাহর পৃৃষ্ঠপোষকতায় ঠুমরি গান সঙ্গীতভুবনে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার সঙ্গীতদরবারে ঠুমরি গায়কদের সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের মধ্যে সঙ্গীতজ্ঞ সাদিক আলী খাঁ ছিলেন তার দরবারের শ্রেষ্ঠ ঠুমরি গায়ক। তার তুল্য ঠুমরি গায়ক তখন লক্ষ্মৌতে আর কেউ ছিল না। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর দরবার সঙ্গীতচর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। উনবিংশ শতকে রাগসঙ্গীতে অনুরাগে রঞ্জিত ঠুমরি গানের যে ধারা নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর পৃষ্ঠপোষকতালাভে পুষ্ট হয়েছিল সে ধারা আজো সঙ্গীতভুবনে অব্যাহত রয়েছে।
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে