শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দূরাগত ট্রেনে

আবু সাইদ কামাল
  ২৭ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৩৮
সন্ধ্যে সাতটা বিশের ট্রেন। তবে দশ মিনিট বিলম্বে স্টেশনে প্রবেশ করেছে। ঢাকায় যাবে আন্তঃনগর এ ট্রেনটি। ‘ঝ’ নাম্বার কোচের নয় নাম্বার সিটে বসেছে আব্দুল আহাদ। জানালাঘেঁষা আসন। বাইরে কনকনে শীতের বাতাস। তাই কাচের পাল্লাটা নামানো। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছুটতে শুরু করে। শহরের আঙিনা ছেড়ে ট্রেন ছুটছে নিরাভরণ গাঁয়ের পথে। একদিকে রাতের অন্ধকার। অন্যদিকে শীতের কবল থেকে বাঁচার জন্য জানালা বন্ধ করে রাখায়, গলা বাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার জো নেই। ঘুরেফিরে ট্রেনের ভিতরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। ধাবমান ট্রেনের চাকার ভাষায় আব্দুল আহাদ বুঝতে পারছে গাড়ি কখন রেলপথে স্টেশন অতিক্রম করছে। কারণ আন্তঃনগর ট্রেন তো সব স্টেশনে থামে না। স্টেশনে স্টেশনে রেললাইনের পয়েন্ট পরিবর্তনের সময় গতিশীল চাকার শব্দের সমিল ছন্দ পরিবর্তন হয়। তবে ছন্দপতন হয় না। আব্দুল আহাদ তা গভীর ভাবে উপলব্দি করে।
ট্রেনটা যখন টানা গতির ইতি টেনে ধীরে ধীরে একটি স্টেশনে থামল, তখন সত্যি সত্যি ছন্দপতন ঘটে। এখানে স্টেশন কর্তৃপক্ষ বেসরকারি একটি ট্রেনের সঙ্গে ক্রসিং দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধার রাতে দূরে আলোর আলামত দেখে বোঝা যাচ্ছিলÑ দূরাগত ট্রেন আসছে।
স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়ানো অবস্থায় একটা সংবাদ বাতাসে ভাসছিল। ট্রেনের হকার বা কোনো কোনো যাত্রীর কাছে শোনা যাচ্ছিল, সামনের রেলস্টেশনে গ-গোল। কী গ-গোল, কেন গ-গোলÑ এসব প্রশ্নের জবাব শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে অনেক যাত্রীই। আব্দুল আহাদ তার আসন ছেড়ে নিচে নেমে জানতে পারে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সাবেক দরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে ওপরের স্তরের প্রভাবশালী এক নেতাকে মনোনয়ন দেয়ায় এ গ-গোলের সূত্রপাত হয়েছে। মনোনয়ন বঞ্চিত পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে স্টেশনসংলগ্ন উপজেলায় হরতাল ডেকেছে। আর হরতাল চলাকালে নাকি বিক্ষুব্ধ লোকেরা বাজারের আট-দশটি দোকানে ভাঙচুর, লুটপাট করেছে। বিশ-পঁচিশটি টেম্পো ভেঙেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে দুটি মোটরসাইকেল। কেউ কেউ বলাবলি করছে, উপজেলা সদরের পরিস্থিতি খুবই অশান্ত। আর তা উপজেলা সদরের রেলস্টেশন পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
ওসব শোনা কথায় প্রথমটায় তেমন গুরুত্ব দেয়নি আব্দুল আহাদ। সেভাবে, ট্রেনে যাচ্ছে; রাস্তায় কোথাও হরতালÑপিকেটিং হলে তাতে ট্রেনের যাত্রীদের কী আসে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিপরীত দিক থেকে বেসরকারি ট্রেনটি এসে ধীরে স্টেশন ত্যাগ করে চলে যায়। আর দাঁড়ানো ট্রেনের আগ্রহী যাত্রীদের কেউ কেউ ধীরে চলমান বিপরীতগামী ট্রেনের যাত্রীদের ডেকে জিজ্ঞেস করে বলে, ওদিকের পরিস্থিতি কেমন?
জবাবে হাতের ইশারায় ওরা জানায়, পরিস্থিতি ভালো না। সরকারি আন্তঃনগর ট্রেন দাঁড় করিয়ে বেসরকারি ট্রেন চলে যায়, এজন্য কেউ কেউ ক্ষোভ ঝাড়ে। সে ট্রেন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটাও ছাড়ে। রাতের স্টেশন অতিক্রম করে ট্রেন ছোটে। অন্ধকারে হেডলাইটের তীর্যক আলোয় সুড়ঙ্গ কেটে ছুটে চলছে ট্রেন। এগিয়ে চলছে সমিল ছন্দে। উপজেলা সদরের স্টেশনের কাছাকাছি এসে থেমেছে ট্রেনটি। আব্দুল আহাদ প্রথমে ভেবেছে, পরবর্তী আপ ট্রেনটা বুঝি স্টেশনে ঢুকছে। এজন্যই হয়তো বা ডাউন ট্রেনটিকে লাইন দিচ্ছে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই হয়তো বা লাইন দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করতে দেবে। কিন্তু এ কী! সময় গড়ায়, অথচ ট্রেনের চাকা তো গড়ায় না। তার ওপর কেউ কেউ বলছে, ট্রেনের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেন। পিকেটাররা আসছে। ওরা রেললাইনের পাথর ছুড়ছে। এসব শুনে মুহূর্তের মধ্যে সারা ট্রেনজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই সড়াৎ সড়াৎ শব্দে জানালা এবং দরজা লাগাচ্ছে। কিছুক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত মনে যাত্রীদের অপেক্ষা...। সবাই কান পেতে আছে। আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে, এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে।
ট্রেনের সব দরজা-জানালা তো ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাজেই বাইরে থেকে ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। হঠাৎ দেখা গেল, একটা লোক বন্ধ করা যায়নি এমন একটি জানালা পথে বাইরে থেকে ভেতরে গলা ঢুকিয়ে বলে, এই যে যাত্রী ভাইয়েরা! সবাই বাইরে নাইমা আসেন। গাড়িতে ভাঙচুর হবে।
অপরিচিত লোকটার এমন আহ্বান সচেতন যাত্রীদের সংশয়ে ফেলে। যাত্রীদের কেউ কেউ বলতে থাকে, সাবধান! কেউ নামবেন না। নামকরা স্টেশন এইটা। অন্ধকারে ট্রেন থেকে নিচে নামলে সে সুযোগে ওরা সর্বস্ব লুটে নেবে।
এ নিয়ে যাত্রীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষ পর্যন্ত কেউ নিচে নামার ঝুঁকি নেয়নি। বাইরের লোকটির আহ্বানে কেউ সাড়া না দেয়ায় সম্ভবত ওরা ক্ষিপ্ত হয়েছে। আর সেজন্যই কিছুক্ষণের ব্যবধানে ওরা পাথর ছুড়তে শুরু করে। ধড়াস ধড়াস, ধুপ-ধাপ শব্দে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে পাথর খ-ের পর পাথর খ-। বেশ কটি জানালায় শুধু কাচের পাল্লা ছিল। ওসব জানালার স্টিলের পাল্লা নামানো যায়নি। পিকেটাররা একের পর এক কাচের জানালাগুলোয় পাথর ছুড়তে থাকে। নিক্ষিপ্ত পাথরের প্রথম আঘাতে কাচে ফাটল ধরে কিছু স্থানে। দ্বিতীয় আঘাতে আরো অসংখ্য ফাটল চিকন রেখায় বিভক্ত হয়। তৃতীয় আঘাতে সড়াৎ করে কাচ ভাঙার শব্দ হয়। অগণিত কাচের টুকরো এসে পড়ে ট্রেনের ভেতরে। আত্মরক্ষায় আতঙ্কগ্রস্ত মানষ ছোটাছুটি শুরু করে। শিশু ও নারীদের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তবু বাঁচার জন্য মানুষের প্রাণপণ চেষ্টা। ট্রেনের বগির যে অংশে দুদিকের স্টিলের জানালা বন্ধ করা আছে, সে জায়গায় এসে মানুষ জড়ো হতে থাকে। কম্পার্টমেন্টের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নির্বিশেষে সব মানুষ গাদাগাদি করে জড়ো হয় একটি স্থানে। ভয়ে জড়োসড়ো সবাই। বাইরে থেকে নিক্ষিপ্ত পাথর কখন কার গায়ে এসে আঘাত হানে সে ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত। আব্দুল আহাদও তখন গাদাগাদি করা লোকের ভিড়ে গিয়ে লুকায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আকস্মিক এক ঘটনায় বুঝতে পারে, সে একজন মহিলার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখে যখন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে আচম্বিত ঢলে পড়তে থাকে, তখন সে অন্য আর একজন লোকের সহযোগিতা নিয়ে মহিলাটিকে ধরাধরি করে পাশের সিটে শুইয়ে দিচ্ছিল। তখনি মহিলার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে মনে হয়, ওই মুখটি তার অনেক দিনের চেনা। মহিলার অচেতন অবস্থা দেখে ততক্ষণে তার চতুদর্শী কন্যাটি কান্নাজুড়ে দেয়। কাঁদতে থাকে তার বারো বছরের ছেলেটিও। দুটি কিশোর-কিশোরী ছাড়া মহিলার সঙ্গে অন্য কোনো স্বজন নেই। ততক্ষণে আব্দুল আহাদ মহিলাটিকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে দরকার তাকে বাঁচিয়ে তোলা। শীতের দিন হলেও সে উপস্থিত বুদ্ধিতে মাথার ওপরের বৈদ্যুতিক পাখাটি চালিয়ে দেয়। অতঃপর নিজের সাইড ব্যাগে রাখা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে মহিলার চোখে কয়েকবার মৃদু ঝাপটা দেয়। এভাবে কিছু মানুষ মহিলাটির শুশ্রƒষা করতে থাকে। আতঙ্কগ্রস্ত অবশিষ্ট মানুষ দুরুদুরু বুকে দুঃসহ সময় পাড়ি দিচ্ছে। কারণ বাইরে থেকে ওরা তখনও চালিয়ে যাচ্ছে বর্বরচিত তা-ব। ওদের অমানবিক আচরণে আব্দুল আহাদের মনে হয় ট্রেনের নিরীহ যাত্রীরাই বুঝি ওদের প্রতিপক্ষ। তাই নির্দোষ যাত্রী সাধারণের ওপর ওদের এই পৈশাচিক আচরণ!
দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে চলে এমন অরাজকতাপূর্ণ তা-ব। তারপর হঠাৎ বিরতি। এক সময় হুইশেল দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করে। পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ট্রেনটাকে টেনে নেয়া হয় স্টেশনে। ততক্ষণে যাত্রীদের শঙ্কা কিছুটা কমতে থাকে। বিক্ষিপ্তভাবে বগি থেকে বগিতে লোক চলাচল শুরু হয়। প্রচ- ঝড়ের তা-ব চলার পর আগ্রহী মানুষ যেমন অন্যদের খোঁজ-খবর নিতে বের হয়, তেমনি ট্রেনে পাথর-নিক্ষেপ তা-ব শেষে শুরু হয় লোক চলাচল। একে অন্যের খোঁজ-খবর নিতে থাকে। আর এভাবে জানা যায়, পাশের দুটি বগিতে নাকি লুটপাট হয়েছে। পিকেটারদের কেউ কেউ নাকি ট্রেনে উঠে গিয়েছিল। ওরা অস্ত্র দেখিয়ে দুটি বগির সব যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। শুধু তাই নয়Ñ ট্রেনের মূল চালককেও নাকি অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। সহকারী চালক ট্রেনটিকে টেনে এনেছে স্টেশনে। আরো জানা যায় যে, আউট সিগনালের কাছে লাইন বা পয়েন্ট পরিবর্তনের তার কেটে দিয়ে নাকি ওরা ট্রেন থামিয়েছে। তারপরই সুপরিকল্পিতভাবে চালিয়েছে লুটপাটসহ পৈশাচিক তা-ব। ট্রেনের পঞ্চাশ-ষাট জন যাত্রী ইট-পাথরের আঘাতে আহতও হয়েছে।
ওদিকে যে মহিলার পাশে বসে সে এসব ভাবছে, সে মহিলা ততক্ষণে চেতনা ফিরে পেয়েছে। দুই চোখ খুলেই ছেে মেয়েকে পরম স্নেহভরে আঁকড়ে ধরে সে। তারপর যখনই আব্দুল আহাদের চোখে চোখ পড়ে, তখনই বিস্ময়ে থ। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে বলে, আপনি...?
আব্দুল আহাদ জবাবে কিছু বলতে পারেনি, তার আগেই তার চতুর্দশী কন্যাটি বলে, উনি কে আম্মু?
ইতস্তত মহিলা। অথচ গর্ভের সন্তানকে সঠিক জবাব তো তার দিতেই হবে। তাই জবাবে বলে, তোর মামার শিক্ষক। আমি যখন কলেজে পড়ি তোর মামা তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। তখন উনি তোর মামাকে পড়াতেন।
এ পর্যন্ত বলে মহিলা একটু থামে। সে ফাঁকে আব্দুল আহাদ সরব হয়। মহিলাকে উদ্দেশ করে বলে, ওরা কি তোমারই ছেলেমেয়ে?
-হ্যাঁ।
-ওরা বুঝি নানির বাড়ি থেকে এলো।
-হ্যাঁ।
-ওদের বাবা...?
-ঢাকার বাসায়।
-ওরা কে কোন ক্লাসে পড়ছে?
-মেয়েটা ক্লাস এইটে। ছেলে ক্লাস সিক্সে।
-খুব ভালো। দোয়া করি বড় হোক ওরা।
আব্দুল আহাদের কথা শেষ হতে পারেনি। তার আগেই মেয়ে শারমিন বলে, আম্মু! উনিই তো ধরাধরি করে তোমাকে এখানে এনে শুইয়ে দিলেন। উনি ওসময়ে না থাকলে যে কি হতো! উনিই তোমাকে সুস্থ করে তুললেন। মেয়ের মুখ থেকে ওসব কথা শুনে মা লজ্জায় চোখ নামায়। বিব্রত রাবেয়া আক্তার রুনা। আব্দুল আহাদ তা আঁচ করতে পেরে বলে, ঠিক আছে এখন আমি আমার সিটে চলে যাই, তোমরা বসো। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এই তো ট্রেন আবার চলতে শুরু করছে।
এই বলে আব্দুল আহাদ একই বগির পিছনের দিকে স্ব-আসনে চলে যায়। পুত্র-কন্যার সামনে রাবেয়া বলতে পারেনি, আহাদ ভাই! আর একটু দাঁড়ান! কত দিন পর দেখা! তা প্রায় আঠারো-বিশ বছর তো হবেই।
ওদিকে আব্দুল আহাদও ভাবতে পারেনি, রাবেয়ার সঙ্গে এমনি কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যাবে। যদিও তার একটা বিশ্বাস ছিল, রাবেয়া একদিন তার কাছে আসবেই। প্রকৃতিই তাদের এমন দেখা সাক্ষাতের আয়োজন করে দেবে। নিশ্চয়ই করবে! এত গভীর আত্মবিশ্বাস আহাদের কোথা থেকে হয়...! এতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়ার একটা কারণ অবশ্য ছিল। চলন্ত ট্রেনে বসে আবার ভাবনায় আত্মমগ্ন হয়। স্মৃতির দূরাগত ট্রেনের প্রতি মনোযোগী হয় সে।
জেলা শহরে কর্মরত অবস্থায় এক সহকর্মী বন্ধু আব্দুল আহাদকে ধরল। বলল, একমাত্র শ্যালকটার পড়ালেখায় মনোযোগ নিই। কিশোর বয়সে যদি উড়নচ-ী হয়ে যায়, তাহলে তো তার জীবনটাই বিফলে যাবে। তাকে নিয়ে আমার শ্বশুরের পরিবার উদ্বিগ্ন। আপনি যদি একটু পড়াতেন...!
সহকর্মী বন্ধু এনামুল হকের অনুরোধে রাবেয়ার ছোট ভাই সুমনকে পড়াতে যেত আব্দুল আহাদ। তখন তার নতুন চাকরি। অবিবাহিত জীবন। অঢেল সময় হাতে। উদ্দাম যৌবন। জেলা শহরে রেললাইনের পাশে একতলা একটা বাসা। বাসাটি ঘেঁষে একটা বড় শিউলি গাছ। দ্বিতীয় দিন বিকালবেলা। সুমনকে পড়িয়ে শেষ বিকেলে ফিরছে আব্দুল আহাদ। ঠিক তখনই পাতার আড়াল থেকে যেন একটি গায়ক পাখি সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে ওঠে,
‘খোল খোল দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও এই দিকে চাও,
এসো দুই বাহু বাডায়ে...।’
আব্দুল আহাদ পিছন ফিওে দোতলার বারান্দায় দেখতে পায় রাবেয়াকে। সেখান থেকেই শুরু। সবে কৈশোরোত্তীর্ণ এক প্রাণবন্ত তরুণী তখন রাবেয়া। চোখ বাঁধানো কিশোরীর সুরেলা কণ্ঠ ঝওে যে নিবেদন ব্যক্ত হয়েছে, তা কি উপেক্ষা করা যায়! আব্দুল আহাদও পারেনি। এরপর প্রতিদিন একই স্থানে অবস্থান করে রাবেয়া অর্থপূর্ণ রবীন্দ্রসংগীতে সুর দিত। আব্দুল আহাদ ফিরে তাকাতো। চোখে চোখে হতো কত অব্যক্ত কথা।
দীর্ঘ এক বছর আব্দুল আহাদ সুমনকে পড়িয়েছে। এই এক বছরে রাবেয়াকে ঘিরে শেষ বিকেলের এমন কত সুখ স্মৃতি আব্দুল আহাদের অভিজ্ঞতার ভা-ারে পুঞ্জীভূত হয়েছে। আর তা শুধু মনের গোলা ঘরই ভরে রাখেনি। প্রতিদিনের টুকরো টুকরো সুখ স্মৃতিগুলো মনের মাধুরী মিশিয়ে বিচিত্র রঙে বাণীবদ্ধ করে রাখে সে ডায়েরিতে। এক বছর পর হঠাৎ আব্দুল আহাদের বদলির আদেশ হয়। কর্মস্থল দূরে। আব্দুল আহাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিদায়ের প্রাক্কালে আব্দুল আহাদ তার লেখা ডায়েরিটা রাবেয়াকে পড়তে দিয়েছিল। অবশ্য তা রাবেয়ার একান্ত অনুরোধে। কারণ ছোট ভাই সুমন কখনো আব্দুল আহাদের মেসে যেত। সেখানে টেবিলে সযতেœ রাখা ডায়েরি একদিন খুলে সুমন পড়েছিল গোপনে। তখন আব্দুল আহাদ ছিল টয়লেটে। এ সংবাদটা সম্ভবত সুমনই রাবেয়াকে দিয়েছিল। বিদায়ের কদিন আগে রাবেয়া আব্দুল আহাদের কাছে ডায়েরিটা চেয়েছিল।
ডায়েরি পাঠের পর রাবেয়া কেন যেন নিজেকে গুটিয়ে নেয়! বিদায়ের সময় আহাদের সঙ্গে আর রাবেয়ার দেখা হয়নি। নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে চলে যাওয়ায় কারণে রাবেয়া কেন নিজেকে গুটিয়ে নিল সেই রহস্যের গ্রন্থি আর উন্মোচিত হয়নি। কিন্তু নিজের উপজেলার কর্মস্থলে যোগদান করেও আব্দুল আহাদ রাবেয়ার জন্যই পাগলপারা। শত দ্বিধার জড়তা উপেক্ষা করে রাবেয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাটি তার সহকর্মী তথা রাবেয়ার দুলাভাইকে জানায়। সহকর্মী তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়। তার সহযোগিতায় রাবেয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ কামনা করে। কিন্তু রাবেয়া সাড়া দেয়নি। দুর্দান্ত বিরহের আগুনে পুড়ে পুড়ে আব্দুল আহাদ কখনো প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে মনে মনে বলত, নিশ্চয়ই জীবনের শেষদিন হলেও রাবেয়ার সঙ্গে একবার আমার সাক্ষাৎ হবেই।
কেন রাবেয়া সাড়া দেয়নি! প্রথমে সহকর্মী বন্ধু এবং পরে নিজের সঙ্গে ওসব নিয়ে বোঝাপড়া কওে সে। আহাদ বুঝতে পেরেছে, একে তো রাবেয়ার লেখাপড়া শেষ হয়নি। তার ওপর বড় বোন অবিবাহিত থাকায় বোনের বিয়ের জটে আটকে ছিল সেও। এ জন্য অবশ্য আব্দুল আহাদ পাঁচ বছর অপেক্ষাও করেছে। তবুও বড় বোনটির বিয়ে হয়নি। রাবেয়াও দেয়নি তেমন সাড়া। ওদিকে আব্দুল আহাদের বাড়ে পারিবারিক চাপ। দীর্ঘ পাঁচ বছর যার জন্য অপেক্ষা, তার পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগও করা হয়নি। তাহলে কেন মিছামিছি অপেক্ষা? আব্দুল আহাদ ভেবে পায় না কেন একটি বছর রাবেয়া তার সঙ্গে প্রণয়াভিনয় করেছে, সেটা কি তার সত্যিই কোনো প্রেম ছিল, নাকি প্রণয়ের ছদ্মবেশে প্রতারণা নাকি ছিল তার খেয়ালি দুষ্টুমি সেটা?
এদিকে পারিবারিক চাপে আব্দুল আহাদ একদিন বন্ধু-বান্ধবসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলায় মেয়ে দেখতে যেতে বাধ্য হয়। কদিন পরই আঞ্চলিক অফিসে সহকর্মী বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হয়। হাসিমাখা মুখে বন্ধুটি আব্দুল আহাদকে স্বাগত জানায়। একান্তে ডেকে নিয়ে বলে, আমার শালিকা রাবেয়া স্থির করেছে, আপনার কাছে ক্ষমা চাইবে। কারণ পাঁচটি বছর সে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এ ব্যাপারে পারিবারিকভাবে আমাদের সিদ্ধান্তও হয়েছে।
বন্ধুটির কথায় আব্দুল আহাদ আশাতীত উল্লসিত হতে পারেনি। কেন পারেনি তাও বলতে পারেনি। বরং প্রসঙ্গ পাল্টে সে এমন ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে আসে যে, ওই বিষয়টা চাপা পড়ে যায়। আব্দুল আহাদ ওদের আশা-প্রত্যাশার গোলাপ বাগানে মই দিয়ে বলতে পারেনি, দুদিন আগে অন্যত্র তার অ্যাঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে।
ট্রেনের একই কামরায় বসে এক বুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আব্দুল আহাদ মনে মনে বলে, যা হওয়ার নয়, তা কোনোদিনই হয় না।
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে