বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১

বশেমুরকৃবিতে জলাবদ্ধতা সহনশীল  উচ্চ ফলনশীল জাতের বিইউ সয়াবিন-৫ উদ্ভাবন 

গাজীপুর প্রতিনিধি
  ৩১ জুলাই ২০২৪, ২৩:২৩
ছবি : যায়যায়দিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) কর্তৃক বিইউ সয়াবিন-৫ নামে সম্প্রতি সয়াবিনের একটি জলাবদ্ধতাসহনশীল, স্বল্পজীবনকাল ও দেশের সবচেয়ে বড় দানা বিশিষ্ট উচ্চফলনশীল সয়াবিনের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে করে সাইক্লোন ও বন্যা কবলিত এলাকায় কম সময়ে এ জাতের সয়াবিন সংগ্রহ করতে পারে। জাতটি ৭দিন পর্যন্ত জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে।

জাতটির উদ্ভাবক বশেমুরকৃবি’র কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল করিম জানান, তাইওয়ানের এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার/ ওয়ার্ল্ড ভেজিটেবল সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট এবং দেশের নোয়াখালী ও লক্ষীপুর এলাকা থেকে প্রায় ২০০ জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে ২০০৬ সাল থেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে সয়াবিন নিয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে বশেমুরকৃবি এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ। এ পর্যন্ত সয়াবিন উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ছয় জন পিএইচ.ডি ও আঠার জন ছাত্র-ছাত্রী এম.এস ডিগ্রী অর্জন করেছেন।

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায়শ:ই সয়াবিনের পরিপক্কতার প্রারম্ভেই সাইক্লোনের জন্য আকষ্মিক অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়। ফলে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় এবং সয়াবিনের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। সে জন্যই উপকূলীয় অঞ্চলের সয়াবিন চাষীদের দীর্ঘদিন যাবত স্বল্পজীবনকাল ও জলাবদ্ধতাসহনশীল জাতের চাহিদা ছিল। সে লক্ষেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবত নিবিড় গবেষনা করা হয়। গবেষনায় দেখা গেছে যে, এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার

থেকে সংগৃহীত জাতের জার্মপ্লাজমটি উচ্চ ফলনের পাশাপাশি সাতদিন যাবত জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে।

জাতটি উদ্ভাবন টিমের প্রধান প্রফেসর ড. আব্দুল করিম জানান যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষকপর্যায়ে এর সঠিকতা যাচাই করার জন্য নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জাতটির মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সম্পৃক্ত করে রবি ও খরিফ দুই মৌসুমেই চাষ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদী এ গবেষনায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় এবং বশেমুরকৃবি এর গবেষনা উইং। কৃষকের মাঠ পর্যায়ে গষেনায় বিভিন্ন আঙ্গিকে সহযোগীতা করেছে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া নামে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ।

সংশ্লিষ্ট কৃষক ও গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমটি সম্প্রতি বিইউ সয়াবিন-৫ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগে নিবন্ধন তথা অনুমোদন পেয়েছে।

বিভিন্ন উপজেলায় জাতটির ফলন পাওয়া গিয়েছে ৩.৫ মে: টন। লক্ষ্যণীয় যে, দেশের অন্যান্য জাতের জীবনকাল যেখানে ১০০-১১০ দিন সেখানে বিইউ সয়াবিন-৫ মৌসুমভেদে ৭৫-৮৫ দিনেই পরিপক্ক হয়। ফলে সয়াবিনের ফল পাকার প্রাক্কালে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে আকষ্মিক জলাবদ্ধতা থেকে জাতটি রক্ষা পাবে। বিইউ সয়াবিন-৫ এর ১০০০-বীজের ওজন ২৮৫ গ্রাম, যা বাংলাদেশের বিদ্যমান যে কোন জাতের চেয়ে বেশী। জাতটির প্রোটিনের পরিমান ৩৮% এবং তেল ২০%।

বাংলাদেশে এখনও পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবেই মুলত: সয়াবিন ব্যবহৃত হয়। তবে ইদানিং বিভিন্ন স্ন্যাকস, সয়ামিট বল ও সয়ামিল্ক হিসেবে এর ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে সয়াবিনকে হাড়বিহীন মাংস বলা হয়। কারণ সয়াবিনে প্রোটিন বা আমিষের পরিমান (৩০-৫৫%), যা অন্যান্য যে কোন ফসল, যেমন ডাল, তেল কিংবা দানাদার শষ্যের তুলনায় অনেক বেশী। তাছাড়া সয়াবিনে ১৮-২০% তেল, ভিটামিন এ, বি, সি ও কে এবং পর্যাপ্ত পরিমানে খনিজ পদার্থ থাকে। এতে যথেষ্ট পরিমান আইসো ফ্লেভিন্স থাকে- যা এন্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ ও এলডিএল কোলেস্টারল কমানোসহ হৃদরোগ, মহিলাদের মেনোপজাল লক্ষণ, বিষন্নতা বা অবসাদ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস,বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে শ্লথ করাসহ বহুবিধ রোগের প্রতিশেধক হিসেবে কাজ করে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন ’কে’ হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপযোগী। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য সয়াবিনের ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত অবশ্যক।

উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ২০১৪ সালে বশেমুরকৃবি এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ থেকে বিইউ সয়াবিন-১ নামে খর্বাকৃতি ও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে পরিপক্ক উচ্চ ফলনশীল এবং ২০২০ সালে বিইউ সয়াবিন-২ নামে উচ্চ ফলনশীল খরা সহিষ্ণু, ২০২৩ সালে বিইউ সয়াবিন-৩ এবং বিইউ সয়াবিন-৪ নামে ২টি লবন সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে- যা কৃষক পর্যায়ে ব্যপকভাবে সমাদৃত। সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে এক মতবিনিময় সভায় জানা গেছে যে, বশেমুরকৃবি কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিকুল পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী সয়াবিনের জাতসমূহ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। তাছাড়া জাতগুলোর বীজের আকার দেশের প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক বড় হওয়ায় এবং জীবনকাল কম ও প্রোটিনের পরিমান উল্লেখযোগ্য হওয়ায় দেশের পশু ও মাছের খাবারের উপকরণ হিসাবেও জাতগুলোর ব্যাপক চাহিদা আছে। উপকুলীয় অঞ্চলে সাইক্লোনের কারণে হঠাৎ জলাবদ্ধ সৃষ্ট জমিতে সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন জাত বিইউ সয়াবিন-৫ বিশেষ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে