রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কারফিউ জারিতে মেহেরপুরে সবজি চাষীদের মাথায় হাত

মেহেরপুর প্রতিনিধি
  ২৫ জুলাই ২০২৪, ১৬:২৮
ছবি-যায়যায়দিন

মেহেরপুরে কোটা বিরোধী কোন আন্দোলন ও সহিংস ঘটনা না ঘটলেও দেশের অনান্য জেলার সহিংস ঘটনার জের মেহেরপুরে জেলার কৃষকদের লোকসানের মুখে ফেলে দিয়েছে। সবজির জেলা হিসেবে পরিচিত মেহেরপুর জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০-৪০ ট্রাক নানান ধরনের সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজার, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল সহ দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয়।

হঠাৎ কোটা বিরোধী আন্দোলনে নাশকতাকারীরা ঢুকে গিয়ে যত্রতত্র গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় কোন ট্রাক আর মেহেরপুর ছেড়ে যাচ্ছে না। তার উপরে দেশে শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে জারি করা হয়েছে কারফিউ।

কারফিউ চলাকালিন প্রায় সকল ব্যাবসা প্রতিষ্টান বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় মেহেরপুরের সবজি চাষীরা তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে না পেরে চরম লোকাসনের মুখে পড়েছে।

স্থানীয় বাজারের চাহীদা অনুযায়ী সবজি বাজারে তোলা হচ্ছে। সঠিক সময়ে সবজি তুলতে না পেরে জমিতেই রাখতে হচ্ছে। এদিকে এখন বর্ষা মৌসুম। ভারি বৃষ্টিপাতে অনেক ক্ষেতের সবজি পচে নষ্ট হচ্ছে। তাই সঠিক সময়ে সবজি বিক্রি করতে না পেরে লোকসানের মুখে পগেছে চাষীরা।

ভৌগলিকভাবে মেহেরপুরের মাটি উঁচু ভূমি হওয়ায় এখানে সব ধরনের চাষাবাদ হয়ে থাকে। তুলনামূলক প্রাকৃতিক দুর্যোগও কম। তাই নানা ধরনের ফসলের সাথে শীত ও গ্রীষ্মকালে ব্যাপক ভাবে সবজি চাষ হয়ে থাকে এ জেলায়। উৎপাদিত সবজি এলাকার চাহীদা মিটিয়ে চলে যায় দেশের অনান্য বড় বড় সবজি বাজারে। বিশেষ করে শীতকালিন সবজি এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও উৎপাদিত হয়ে থাকে মেহেরপুরে।

বর্তমানে মেহেরপুরের মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে বেগুন, কাঁচা মরিচ, পাতা কপি, ফুল কপি, পটল, ঝিঙ্গে, চিচিঙ্গা, কলা, কুমড়ো, শশা, লাল শাক, সাদা শাক, পুঁই শাক, করলা, কাকরোল, পেপে, ওল, কচু, লাউ সহ প্রায় সকল ধরনে সবজি। এসব সবজি চাষ করে কৃষক তাদের স্বপ্ন পূরণ করা সহ পরবর্তী চাষাবাদের টাকা যোগাড় করে থাকেন।

সদর উপজেলার উত্তর শালিকা গ্রামের চাষি সোহাগ রহমান বলেন, আমি ৪ বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। এ পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ টাকার মরিচ বিক্রি করেছি। আরো অন্তত দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকার মরিচ বিক্রি হবে বলে আশা করেছিলাম। তবে মরিচ বাইরে পাঠাতে না পারায় জমি থেকে উঠাতে পারছিনা। সঠিক সময়ে বিক্রি করতে না পারলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে যাবো। চলতি মৌসুমে মেহেরপুর জেলায় প্রায় ৮শ ৯০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে।

উৎপাদিত কাঁচা মরিচ পাইকারি ২শ থেকে ২শ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। মরিচ এখন বাইরের জেলাতে পাঠাতে না পারার কারনে বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে। এই বর্ষা মৌসুমে মেহেরপুরে প্রায় ৭শ ৬২ হেক্টর জমিতে বাঁধা কপির চাষ হয়েছে। বাজার দর ভালো থাকার কারনে বাঁধা কপি চাষে লাভবান হচ্ছিল চাষি। গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের কপি চাষী জুলি মহাম্মদ বলেন, আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরন করে এই বর্ষায় মাত্র ৯০ দিনে কপি বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমিতে সার-বীজ,কীটনাশক সহ চাষ খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদিত কপি বিক্রি করে ঘরে আসছে ৯০ থেকে ১ লাখ টাকা। খরচ বাদে লাভ হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। অথচ বর্ষায় কপি সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারলে জমিতে পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে লোকসানের কবলে পড়ে আমাদের কপাল পুড়বে।

মেহেরপুর বড় বাজারের খুচরা সবজি ব্যবসায়ী কালু মন্ডল বলেন, হঠাৎ দেশে অস্থিরতার কারনে বাজারে সবজির দাম অনেক কমে গেছে। বাইরের সবজি পাঠাতে না পারার কারণে চাষীরা লোকসানের মধ্যে পড়ে গেছে। জেলায় যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় তার সামান্যই মেহেরপুরের বাজারে বিক্রি হয়। অধিকাংশ সবজি বাইরের জেলায় সরবরাহ করা হয়।

কয়দিন আগেও বাজারে সবজির দাম ছিলো আকাশচুম্বি। দেশে অস্থিরতার কারনে স্থানীয় বাজারে ৭০-৮০ টাকার বেগুন ৩০-৩৫ টাকায়, ২৫০-৩০০ টাকার কাঁচা মরিচ ১৭০-১৮০ টাকায়, ৪০-৪৫ টাকার পাতা কপি ২৫-৩০ টাকায়, ৫০-৬০ টাকার ফুল কপি ৩০-৪০ টাকায়, ৫০ -৬০ টাকার পটল-৩৫-৪০ টাকায়,৭০-৮০ টাকার ঝিঙ্গে ৩৫-৪০ টাকায়, ৪৫-৫০ টাকার চিচিঙ্গা ২৫-৩০, ৪০-৫০ টাকার শশা ২৫-৩৫ টাকায়,৪০-৫০ টাকার লাউ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনি ভাবে প্রায় সকল সবজির দাম অর্ধেক নেমে এসেছে। তার উপরে স্থানীয় বাজারেও ক্রেতা কম আসছে। সবজি বিক্রেতারা মানুষের বাড়ির আশপাশে গিয়ে সবজি বিক্রি করছে। তাই বাজারে এখন বেচা কেনা খুবই কম।

কাঁচা মালের আড়ৎদার মিজানুর রহমান বলেন, অনান্য যেকোন সময়ের চেয়ে এবছর সবজির দাম ছিলো সর্বোচ্চ। হঠাৎ দেশে অস্থিরতার কারনে বাইরের পাইকারী সবজি ক্রেতারা মেহেরপুর ছেড়ে চলে গেছে। তাই আড়তে এখন স্থানীয় কাঁচা মালের ফড়িয়ারা ভরসা। চাহীদার তুলনায় আমদানি হচ্ছে ব্যাপক। অথচ বিক্রি করার জন্য কোন ক্রেতা পাচ্ছি না। এতে জেলার কৃষকরা মারাত্বক ক্ষতির মুখে পড়ে গেছেন। হঠাৎ সবজির দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে চাষীরা চরম লোকসানের মুখে পড়ে গেছেন।

ট্রাক মালিক হাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে জানান, সড়কে যেভাবে গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে তাতে আমরা সবজি বোঝাই ট্রাক পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও গাড়ি পাঠানো হবে। গাড়ির চাকা ঘুরলে আমাদের রুটি রুজি হয়। আমরা চাই শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাক, তাহলে আমরা ট্রাক ভাড়া দিয়ে চলতে পারবো।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালাদার যায়যায়দিনকে জানান, জেলায় ব্যাপক হারে সব ধরনের সবজির চাষ হয়ে থাকে। সবজির বাজার দরও ভাল। কৃষক লাভবান হচ্ছিল।

হঠাৎ পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ে গেছেন। তবে প্রশাসন থেকে সবজি সরবরাহে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেও ট্রাক মালিকরা এখনও আতঙ্কে আছেন। আশা করছি খুব শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। কৃষকরা আবার আগের মত কৃষি পণ্য অনান্য জেলায় সরবরাহ করে লাভবান হতে পারবেন।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে