শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা

যাযাদি রিপোর্ট
  ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সুদহার অনেক কম হওয়ায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। তবে বিদেশি ঋণ দেশের জন্য বোঝা। যতই সস্তা সুদ হোক এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। এই ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনুমোদন থেকে শুরু করে ব্যবহার পর্যন্ত কঠোর তদারকির প্রয়োজন।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মোট (সরকারি ও বেসরকারি) বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৮৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা (১ ডলার = ৮৫ টাকা)। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৫৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারে (৫ লাখ ৬২ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা)। এর মধ্যে সরকারিভাবে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫১ কোটি ৫২ লাখ ডলার এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৪০৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। বিশ্লেষকদের মতে একটি দেশের অর্থনীতির জন্য বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অলস টাকা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এ থেকে যে সুদ পরিশোধ করত তা দেশেই থেকে যেতো। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কোনো চাপ বাড়ত না। এতে ব্যাংকগুলোরও তহবিল ব্যয় কমতো যার সামগ্রিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ত। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ নেওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ পরিশোধ করছে ন। এতে এসব ঋণের সুদ বৈদেশিক মদ্রায় চলে যাচ্ছে বিদেশে। এ ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মদ্রার মজুদের ওপর চাপ পড়বে। ইতোমধ্যে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় ও আমদানি ব্যয় তুলনামূলক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ বাড়তে থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না।

দেশের ব্যাংকগুলোতে বেড়ে গেছে ঋণের সুদ হার। উচ্চ সুদের হাত থেকে বাঁচতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা আবার ঝুঁকে পড়েছেন বিদেশি ঋণের দিকে। লাইবরের (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক রেট) সাথে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ দিলেই মিলছে বিদেশি ঋণ। ফলে বিদেশি ঋণের সুদ পড়ছে সাড়ে ৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশি ঋণের সুদ আপাতদৃষ্টিতে সস্তা মনে হলেও ডলার টাকার বিনিময় হারের হিসাব করলে কার্যকর সুদহার অনেক বেড়ে যাবে। সেই সাথে দেশের ওপর বাড়বে সুদসহ বিদেশি ঋণের বোঝা।

ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকেরই চরম অর্থসংকট চলছে। এ অবস্থায় টাকার সংকট মেটাতে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করেছে। গড়ে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই এখন ডাবল ডিজিটে আমানত সংগ্রহ করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত নিচ্ছে। উচ্চ সুদে আমানত নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে কিছু উদ্যোক্তা আবারও বিদেশি ঋণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগাযোগ শুরু করেছেন। তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও কার্যকর সুদহার আরও বেড়ে যাবে। যেমন একজন বিনিয়োগকারী বিদেশ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে ১০০ কোটি ডলার (৮৪ টাকা প্রতি ডলার হিসেবে) ঋণ গ্রহণ করল। এক বছর পর প্রতি ডলার ৯০ টাকা হলে প্রতি ডলারে টাকার মান কমে প্রায় ৭ শতাংশ। ডলারে ঋণ করে টাকায় ব্যয় করলেও ডলারে পরিশোধ করায় বিনিময় হারের কারণে সুদ ব্যয় বেড়ে হবে (৬.৫+৭) সাড়ে ১৩ শতাংশ। এভাবে কেউ ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি বিদেশি ঋণ নিলে কার্যকরী হার অনেক বেড়ে যাবে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, আমাদের দেশের অর্থিক খাত খুবই সরু ও দুর্বল। সে ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। তবে বিদেশি ঋণের যথাযথ ব্যবহার ও বিদেশি ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতার কোনো বিকল্প নেই। এই চাপ বাড়তে থাকলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চাপ সৃষ্টি হবে বলে মনে করনে তিনি।

তিনি আরও জানান, যেহেতু এ মুহূর্তে বিদেশি ঋণের সুদহার কম এবং অদূর ভবিষ্যতে তা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই এই পথ খোল রাখাটাই ভালো। তবে ঝুঁকিও আছে। আমারা এখনো এমন পর্যায়ে যায়নি যে বড় ধরনের কোনো ঋণের বোঝা আসলে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কারণ আমাদের রিজার্ভ কন্ডিশন এখনও অনেক ভালো। তবে টাকার অবমূল্যায়ন মাথায় রেখে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।

বিদেশি ঋণের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলক সুদ কম হওয়ায় বর্তমানে বিদেশি ঋণের সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছে ইউরোপের দেশ জার্মানি। এছাড়া বড় অংশের জোগানদাতা ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন ও জাপান। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিতরণে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এর পরের অবস্থানে রয়েছে দেশীয় ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল), সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এবি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

দেশীয় ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমেও ঋণ নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশীয় ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের অর্থের উৎস খতিয়ে দেখা দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে জার্মানি।

দেশে আসা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণই আসছে দেশটি থেকে। একক দেশ হিসেবে যা সর্বোচ্চ। গবেষণায় বলা হয়, লাইবর (লন্ডনের শীর্ষ ১৫ ব্যাংকের আন্তঃলেনদেনে সুদহার) রেটের সঙ্গে তিন ও তিন দশমিক ৯ শতাংশ সুদে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউরো ও বাংলাদেশি ব্যাংকের সুদহারে নেওয়া হয়েছে। এখন লাইবর রেট বৃদ্ধি ও টাকার বিপরীতে ডলারের দর বৃদ্ধিতে এসব ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79506 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1