শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরে বেকার ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক

ব্যবসায়ীদের দাবি
যাযাদি রিপোর্ট
  ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে পোশাক খাত একটি বিকাশমান ও সম্ভাবনাময় খাত। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই খাতটিতে সরকারের নগদ প্রণোদনাসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। এরপরও এ খাতে আসছে না নতুন কোনো উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৩টি নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। আর এর বিপরীতে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৬০টি। এতে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।

এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাত। এখন পর্যন্ত রপ্তানি আয় গেল অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। সংশ্লিষ্টরা বলছে, সার্বিকভাবে খাতটি 'ভালো না থাকায়' নতুন কারখানা গড়ে ওঠার হার কমছে। তথ্যমতে, ২০১৭ সালে দেশে ১৩৩টি নতুন তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠে; ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬১টি। আর ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত দেশে গড়ে উঠেছে মাত্র ৫৩টি তৈরি পোশাক কারখানা। এসব কারখানা বিজিএমইএ'র সদস্য পদও লাভ করেছে। বিপরীতে চলতি বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ৬০টি কারখানা। এতে চাকরি হারিয়েছে ২৯ হাজার ৫৯৪ জন শ্রমিক।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত। নভেম্বরসহ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১ হাজার ৩০৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১ হাজার ৪১৮ কোটি ডলার। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এদিকে ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারকের মুকুট হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার ৩৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪৫৬ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। এ থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় বেড়েই চলছে।

সূত্র জানায়, যে বছরে নতুন কারখানা চালু হয় অধিকাংশ সে বছরই বিজিএমইএ'র সদস্য পদ লাভ করে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিছু কিছু কারখানা হয়তো ট্রায়াল বেসিসে কাজ করেছে। তবে এ বছরই তারা সদস্য হয়েছে। ফলে চালু হওয়ার ক্ষেত্রে এসব কারখানা একেবারেই নতুন। তবে এসব কারখানা আগামী দুই বছরে অপারেশনে যেতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতির।

বিজিএমইএ'র সভাপতি রুবানা হক বলেন, 'পোশাক খাত ভালো করছে না। কয়েক মাস ধরেই প্রবৃদ্ধি কমছে। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। রানা পস্নাজার পর বিজিএমইএর প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সে তুলনায় নতুন করে গড়ে ওঠা কারখানার সংখ্যা কম। আবার চালু হওয়ার মধ্যে বড় অংশই স্থানান্তরিত কিংবা নতুন কোনো ইউনিট স্থাপন।' রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার পেছনে প্রতিযোগী দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ডলারের অবমূল্যায়ন না করা ও মজুরি বৃদ্ধির মতো প্রভাবই অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি।

বিজিএমইএ'র সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদের মতও একই। তিনি বলেন, 'প্রতিযোগী দেশের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও ডলারের অবমূল্যায়ন না করার কারণেই পোশাক রপ্তানিতে আয় কমছে। অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে নতুন করে পোশাক কারখানা গড়ে ওঠার হারও কমছে। তবে ভিয়েতনাম এখনো বাংলাদেশকে স্পর্শ করতে পারেনি, কাছাকাছি চলে এসেছে।'

বিজিএমইএ'র পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, 'বর্তমানে অ্যাকর্ড ও নিরূপণের ঝামেলা রয়েছে। ২০ থেকে ২৫ বছর আগে এতো ঝামেলা ছিল না। বায়াররা আসতো। তারা অর্ডার নিয়ে যেত। এখন মার্জিন বলতে কিছু থাকছে না। সামনের দিনগুলোকে আরও শঙ্কার মনে হচ্ছে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ তাদের মুদ্রার ডি-ভ্যালু করছে। আগে মিয়ানমারে রপ্তানি আয় ছিল ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার; এখন তা ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে রপ্তানির যে পার্থক্য ছিল তা দিনদিন কমে আসছে। গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমছে। বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো আমরা ১৫ শতাংশ পিছিয়ে আছি। সেটিও আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। নানা কারণেই এখন আর নতুন কারখানা গড়ে উঠছে না। যুক্ত হচ্ছে না নতুন কোনো উদ্যোক্তাও।'

বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'বৈশ্বিকভাবে পোশাকের চাহিদা কমছে। ক্রয়ের প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়েছে। তাজরিন ও রানা পস্নাজা দুর্ঘটনার পর আমরা শুধু পোশাক কারখানা সংস্কার করেছি। আমাদের যে বিপণনে শক্ত হতে হবে, বায়ারদের কাছে পণ্য নিয়ে যেতে হবে, দেশকে ব্রান্ডিং করতে হবে- সেই জিনিসটি করা হয়নি। এ কারণে আমরা বিপদের মধ্যে আছি। প্রতিযোগিতায় এখন টিকে থাকা কষ্টকর। এখন উদ্যোক্তা ও সরকার উভয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশে কিছু ফ্যক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কিছু চালুও হয়েছে। কিন্তু এখন যত অর্ডার আসছে, তার চেয়ে আমাদের ক্যাপাসিটি বেশি আছে।'

তিনি আরও বলেন, '২০২০ সালে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা ৬০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি ৪৮০ বিলিয়ন ডলারে উঠে হঠাৎ করেই ৪৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। অর্থাৎ পোশাকের চাহিদা এখনো বাড়েনি। আবার চীন থেকে যে অর্ডার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল তাও সেভাবে যাচ্ছে না। এছাড়া আগে আমাদের খরচ কম ছিল, এখন আর তা নেই। খরচের দিক থেকে এখন আমরা চীন ও ভিয়েতনামের কাছাকাছি।'

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে গার্মেন্টস বন্ধের কারণ সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক মানদন্ড মানেনি। যারা মানদন্ড মেনেছে সেগুলো বন্ধ হয়নি। অনৈতিক ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবসার কারণেও মালিকপক্ষ বেকায়দার পড়ছে। মাসে মাসে ওইসব ট্রেড ইউনিয়নকে মাসোয়ারা দিতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়া গার্মেন্টস বন্ধের কারণ বলেও মনে করেন কেউ কেউ। বায়ারদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে না পারাও গার্মেন্টস বন্ধের কারণ। অনেক মালিকই মনে করেন, কোনো রকমে নিজের কারখানা চালু থাকুক। কারণ তাদের অনেকই বিশাল ব্যাংক ঋণের ফাঁদে পড়ে আছেন। আবার নূ্যনতম মূল্যও ঠিক করা যাচ্ছে না মালিকদের কারণেই। এটি করা হলে বায়াররা ক্ষিপ্ত হতে পারেন বলে তাদের ধারণা।

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ পোশাক কারখানার বিদেশে শাখা অফিস রয়েছে। অর্ডার পাওয়ার পর ওই শাখা অফিসের মাধ্যমে কাজটি দেশে আনা হয়। শুধুমাত্র কাজটি উঠিয়ে নিতে যে খরচের টাকা তা দেশে আসে। আবার অনেক কারখানা মালিকেরই দেশের বাইরে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সংগত কারণেই তারাও রপ্তানি কম দেখিয়ে থাকেন। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও পোশাকের ক্রেতা কমেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79190 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1