শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশি বিনিয়োগে স্বস্তি

ইমদাদ হোসাইন
  ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) এবার স্বস্তি ফিরেছে। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের শেষ নাগাদ বিদেশি বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৫ বিলিয়োন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে এসে হঠাৎ করে বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দেয়। ২০১৭ সালে এফডিআই আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমে এসে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ ২০১৬ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

সর্বশেষ তথ্য হালনাগাদে আরও দেখা যায়, ২০১৮ সালের মোট এফডিআইয়ের এক-তৃতীয়াংশই এসেছে বাংলাদেশে কার্যরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে। অঙ্কের বিচারে এর মোট পরিমাণ ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আর নিরাপদ বিনিয়োগ ছিল ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে দেশীয় কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ এসেছে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান দেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকে বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমরা এমন খবরে খুবই আনন্দিত। কিন্তু অঙ্কের বিচারে এটি খুবই সামান্য। কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, চাকরির বাজার তৈরি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনের দিকে নজর দিয়ে এই বিনিয়োগ আরও বাড়ানো দরকার।

তিনি আরও বলেন, দেশে মোট এফডিআই জিডিপির অনুপাতে ২ শতাংশ নিচে আছে। দীর্ঘ মেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য ৪ থেকে ৫ শতাংশ আরও বাড়াতে হবে। ভিয়েতনামে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমরা এখনো এফডিআই ৫ বিলিয়ন ডলারের দিকে আকর্ষণ করার সংগ্রামে আছি।

এখন আমাদের দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার সময় এসেছে বলেও মত দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও সেখানে কোন দেশ থেকে কত এফডিআই এসেছে তা প্রকাশ করা হয়নি। শুধু অক্টোর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশভিত্তিক এফডিআইয়ের তথ্য দেয়া হয়েছে।

আগের ও বর্তমান উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এফডিআই সবচেয়ে বেশি এসেছে চীন থেকে। এ সময় দেশটির বিনিয়োগ ছিল ১.০৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে কোন খাতে কত এফডিআই এসেছে তাও পরিষ্কার করা হয়নি। শুধু গত বছরের শেষ প্রান্তিকের তথ্যে দেখা যায়, কোন খাতে কত বিনিয়োগ হয়েছে সেটিই পরিষ্কার করা হয়েছে। অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে বাংলাদেশের এফডিআইয়ের খাত বিশ্লেষণে জটিলতার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত না হবার পেছনে এখনো বড় বাধা জমি পাওয়ার বাড়তি খরচ। এছাড়া মামলা মোকদ্দমায় জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগের খরচও বেড়ে যায়। অনেকের মতে, এখন বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। যা অনেক বিনিয়োগকারীকে সিদ্ধান্ত নিতে ভাবনায় ফেলছে। সস্তা শ্রমের কথা ভেবে অনেক বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পেলেও অবকাঠামো সমস্যা পিছিয়ে দেয় এমন বিনিয়োগকারীও কম নেই।

এছাড়া গত কয়েক বছর নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির কথা বলা হলেও গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির নির্বিঘ্ন নিশ্চয়তা মেলেনি। শিল্প স্থাপনে জমির স্বল্পতা, দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এসব কিছুই বিদেশি বিনিয়োগকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

২০২১ সালে মধ্যম আয়ের ও ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে প্রতি বছর শুধু বিদেশি বিনিয়োগই প্রয়োজন ১ হাজার কোটি ডলার। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার শর্ত পূরণ করতে হবে এজন্য প্রয়োজন প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ। কৃষি ও গার্মেন্টের মতো উৎপাদন খাতে গত কয়েক বছর বেশ বিনিয়োগ এসেছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদু্যৎ খাতেও নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে। বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আদর্শ গন্তব্যস্থল বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। এজন্য আগামী দিনে আরো নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে সরকারকে। এ জন্য রপ্তানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন সুযোগ ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মতো সম্ভাবনাময় খাত নির্বাচন করে বিনিয়োগকারীদের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে চ্যালেঞ্জ তা মোকাবিলা অনেকখানি সহজ হয়ে আসবে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তাদের মুনাফা প্রত্যাবাসন বা ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিধি বিধান শিথিল করা হয়েছে, এছাড়া নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির অবচয় সুবিধা, শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশিরা।

এসব সুবিধা ধারাবাহিকভাবে বজায় রেখে প্রতি বছর যে বিনিয়োগ নিবন্ধন হচ্ছে তা সময়মতো বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে, তবেই গতি ফিরবে বিদেশি বিনিয়োগের।

বাংলাদেশ যেসব মাধ্যমে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ঘটাতে আগ্রহী সেগুলি হচ্ছে যৌথ উদ্যোগে শিল্প স্থাপনা, কারিগরি লাইসেন্সিং, প্রতি-বাণিজ্য, সহ-উৎপাদন চুক্তি, ব্যবস্থাপনা চুক্তি, বিপণন সহায়তা, টার্ন-কি কার্যক্রম ইত্যাদি। বাংলাদেশে ব্রিটেনের কয়েকটি কোম্পানির কারিগরি সহযোগিতায় সিগারেট, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও ওষুধপত্র উৎপাদিত হচ্ছে। এ জাতীয় সহযোগিতার নজির তৈরি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া (বৈদু্যতিক সামগ্রী) এবং থাইল্যান্ডের (রং) সঙ্গেও। বিপণন সহযোগিতার উদাহরণ হচ্ছে চা এবং তৈরি পোশাক শিল্পে স্টার্লিং এলাকার কয়েকটি কোম্পানি। লাইসেন্সিং চুক্তি আছে প্রধানত রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ খাতে। তবে সমমূলধনে অংশগ্রহণ ছাড়াই দেশীয় বেশ কয়েকটি কোম্পানি কোন কোন আন্তঃদেশীয় কোম্পানির ব্র্যান্ড পণ্য উৎপাদনের সুযোগ পেয়েছে।

বাংলাদেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বিনিয়োগযোগ্য তহবিল সৃষ্টিতে এবং উৎপাদন, বাণিজ্য ও সেবা খাতে বিনিয়োগের জন্য স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহে সরাসরি ভূমিকা রাখে। বিদেশি বিনিয়োগ ও তার অনুষঙ্গী স্থানীয় বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, স্থানীয় কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, গবেষণা ও উন্নয়নের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং সর্বোপরি সরকারের জন্য রাজস্ব আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি করে।

অবশ্য বাংলাদেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সামান্যই ভূমিকা রেখেছে। দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির মাত্র ১.৫% এবং শ্রমজীবী সমস্ত জনসংখ্যার মাত্র ০.২% বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানাদিতে নিয়োজিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<46744 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1