বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

খেতের ফসল পচে যাচ্ছে খেতেই

যাযাদি ডেস্ক
  ০৭ মে ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ মে ২০২০, ১০:২৪
বাঁধাকপি খেতে অসহায় কৃষক -যাযাদি

গ্রীষ্মকালীন সবজিতে অধিক লাভ হয় প্রতিবছরই। তবে এ বছর গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এমনকি এসব বাঁধাকপি বিক্রি করে শ্রমিকের খরচও উঠছে না। শ্রমিকের খরচ এবং পরিবহণের কথা চিন্তা করে কৃষকের বাঁধাকপি এখন খেতেই পচে যাচ্ছে। খরচের ভয়ে খেত থেকে তুলছেন না বাঁধাকপি। এদিকে স্থানীয় বাজারে যার দাম ২-৫ টাকার মধ্যে। মাঠ থেকে যা আনতেই খরচ হয়ে যায় ৩-৪ টাকা। কৃষকরা দাবি করছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বাঁধাকপি জেলার বাইরে পাঠাতে পারছেন না। বাইরে থেকে পাইকারি ক্রেতারাও আসতে পারছেন না। তাই বাঁধাকপি না কাটার কারণে খেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ এলাকার কৃষক সিহাব উদ্দিন। তিন বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছেন। এখন পর্যন্ত একটা বাঁধাকপিও বাজারে বিক্রি করতে পারেননি। খেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার বাঁধাকপি। গতবছর বেশ ভালো ফলন পেলেও বাঁধাকপিতে এবার পুরো লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি। সিহাব উদ্দিন বলেন, শীতকালে এই এলাকায় ব্যাপক হারে সবজির চাষ হয়। এর মধ্যে বাঁধাকপি অন্যতম। এই এলাকায় বাঁধাকপি অনেক ভালো হয়। তবে শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালের বাঁধাকপির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। বাজারে এ সময় চহিদাও বেশ ভালো থাকে। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমি গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছি। তাই এবারও আমি এবং আমার ভাই উসমান গণি মিলে তিন বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছি। তিনি বলেন, নিজেদের জমি হওয়ায় উৎপাদন খরচটা তুলনামূলক কম। সেই সঙ্গে জৈব সার ব্যবহারের ফলে রাসায়নিক সারও কম লাগে। আর রোগবালাইও কম দেখা যায়। গত বছর আমি ৮-১০ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি খরচ করেছিলাম। বাজারও বেশ ভালো ছিল। বিঘাপ্রতি ৭০-৮০ হাজার টাকার বাঁধাকপি বিক্রি করেছিলাম। তিনি আরও বলেন, এ বছর বিঘাপ্রতি চার থেকে সাড়ে চার হাজার বাঁধাকপির চারা রোপণ করেছি। গাছ এবং কপিও বেশ ভালো হয়েছে। খেতে কোনো রোগবালাই হয়নি। সেই সঙ্গে আবহাওয়াও বেশ অনুকূলে ছিল। গত বছর প্রতি পিস বাঁধাকপি আমি জমি থেকেই পাইকারি ১৫-২০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলাম। এ বছরও প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো বা এরও বেশি হতো। তবে এই করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। সেই সঙ্গে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় বাইরের জেলার ক্রেতারা আসতে পারছেন না। যেই বাঁধাকপি জমি থেকেই পাইকারি দামে ক্রেতারা কিনে নিয়ে যায় সেখানে কোনো ক্রেতাই আসছে না। সিহাব উদ্দিন বলেন, বাজারের যে অবস্থা প্রতি পিস বাঁধাকপি ৩-৪ টাকা। স্থানীয় বাজারে কপি ২-৩ টাকা করে। জমি থেকে তুলে বাজারে নিতে যা খরচ তার চেয়ে কপির দাম কম। এমন থাকলে কপি কাটা শ্রমিকের দাম উঠবে না। অপর কৃষক উসমান গণি জানান, জমির বাঁধাকপি বিক্রির উপযুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। এই করোনার জন্য এবং দামের যে অবস্থা এজন্য বাঁধাকপি কাটিনি। এর ওপর আবার দুদিন বৃষ্টি হলো। এতে খেতের কপি এখন খেতেই নষ্ট হচ্ছে। বাইরের জেলার ক্রেতারা না আসলে তো এবার পুরোটাই লস হয়ে যাবে। কৃষক হারুন জানান, প্রতিবছরই এই এলাকায় বাঁধাকপির দাম বেশ ভালো থাকে। এবার করোনার কারণে একদম কম। আমরা খেত থেকে বাঁধাকপি তো তুলব কিন্তু বেঁচব কোথায়। ১-২ টাকা দামে বিক্রি করতে হবে। এর চেয়ে জমিতে থাকায় ভালো। লেবার খবর, গাড়ি ভাড়া ঘর থেকে দিতে হবে এমন হলে। আবুরী মাঠপাড়া এলাকার কৃষক আক্তার আলীও অধিক লাভের আশায় এক বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছেন। তারও একই অবস্থা। বাজারে দাম ও চাহিদা না থাকায় তিনিও বিক্রি করতে পারছেন না বাঁধাকপি। তিনি জানান, প্রতিবছর এ সময় বাঁধাকপির বেশ দাম ভালো পাওয়া যায়। তাই এ বছর গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছি। কিন্তু এবার করোনার কারণে বাজারে লোকও নেই, দামও নেই। এক টাকা, দুই টাকায় কপি বিক্রি করে কোনো খরচই উঠবে না। আবুরী এলাকার কৃষক তুজাম আলী জানান, এ বছর গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে আমরা বিপাকে পড়েছি। দাম নেই বাজারে। বাঁধাকপি কাটা, বাজারে নিয়ে যাওয়া যে খরচ সেটাও ঘর থেকে দিতে হবে মনে হচ্ছে। প্রতিবছর ক্রেতারা জমিতে এসে বাঁধাকপি নিয়ে যেত। করোনার কারণে বাইরে থেকে ক্রেতারা আসতে পারছেন না। এসব চাষিদের দাবি, স্থানীয় বাজারের চেয়ে প্রতিবছর জেলার বাইরে থেকে ক্রেতারা আসেন। তাদের মাধ্যমে বিক্রি করলে বেশ ভালো লাভ হয় তাদের। সরকারি কোনো উদ্যোগ ছাড়া এসব বাঁধাকপি খেতেই নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানায় কৃষকরা। জেলার অন্যতম বৃহত্তর পাইকারি কাঁচা সবজির বাজার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি বাজার। করোনার কারণে সেখানেও নেই ক্রেতার তেমন উপস্থিতি। বাইরে থেকে ক্রেতারাও তেমন আসছে না। খলিসাকুন্ডি কাঁচাবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম জানান, করোনার কারণে বাইরের ক্রেতারা ঠিকমতো আসছে না। আমরাই সবজি বাইরে পাঠাতে সমস্যায় পড়ছি। বাঁধাকপির ক্রেতা না থাকায় বাজারে দাম একদম কম। পাইকারি ৪-৬ টাকা পিস হিসাবে বিক্রি হচ্ছে। আমলা সবজি বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা আশরাফুল আলম সেতু জানান, বাজারে অন্য সময়ের তুলনায় বাঁধাকপির দাম অনেকটাই কম। আমদানির ওপর এর দাম নির্ভর করে। খুচরা প্রতিটি বাঁধাকপি ৮-১০ টাকায় বিক্রি করছি। কুষ্টিয়া শহরের রাজার হাটের পাইকারি বাজারের সবজি ব্যবসায়ী রিয়ন আলী জানান, কিছুদিন আগে বাঁধাকপি কেজির দামে বিক্রি করেছি। এখন সেটা পিস হিসাবে। দাম কমেছে প্রায় অর্ধেক। ১০ টাকা কেজিদরের বাঁধাকপি এখন একটাই ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে রাজশাহীর সাহেব বাজার এবং পাবনার বড় বাজারের সবজির আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানেও গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির দাম খুবই কম। ক্রেতার সংখ্যা কম থাকায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন তারা। কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় এ জন্য সরকার ২০১৫ সালে আবুরী এলাকায় কৃষিপণ্য সরবাহ ও বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে ওই এলাকার ২০ জন কৃষকের সমন্বয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে উক্ত বিপণন কেন্দ্রটি পরিচালিত হওয়ার কথা। তারা কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে পুরো ইউনিয়নের সবজি কিনে জেলার বাইরে যেখানে চাহিদা ভালো সেসব বাজারে বিক্রি করে লভাংশের টাকা কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে বণ্টন করেন। তবে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ ওই বিপণন কেন্দ্রের জমির মালিক জুমারত আলী নিজের ইচ্ছা মতো কেন্দ্রটি ভোগদখল করে আসছে। তারা কৃষকদের কোনো পণ্য কিনতে চান না। আর সবজিচাষিদের বিভিন্ন হয়রানি করার কারণে তারাও সেখানে যেতে চান না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুরী কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জুমারত আলী জানান, কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মিরপুর উপজেলার ঝুটিয়াডাঙ্গা, আবুরী এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক প্রতিবছরই গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করে। এ বছরও প্রায় ১০-১২ বিঘার মতো জমিতে তারা বাঁধাকপির চাষ করেছেন। মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি চাষটা বেশ লাভজনক হওয়ায় মিরপুরের বেশ কয়েকজন কৃষক এই বাঁধাকপির চাষ করে থাকেন। প্রতিবছর তারা বেশ ভালো দাম পেয়েছেন। বিঘাপ্রতি খরচ বাদ দিয়ে ৫৫-৬০ হাজার টাকা করেও লাভ করেছেন। বিগত বছর দেখা গেছে, পাইকারি ক্রেতারা এসে কৃষকদের জমি থেকেই ভালো দামে বাঁধাকপি কিনে নিয়ে গেছে। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে একটু অসুবিধা হচ্ছে। দাম অনেকটাই কম। তবে কৃষকরা যাতে ন্যায্য দামে বাঁধাকপিসহ অন্যান্য সবজি বিক্রি করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার পাইকারি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাতি পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারেন, এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তর থেকেও আমাদের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক আমরা কাজ করছি। জেলার বাজার কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, বাজারে বাঁধাকপির চাহিদা অনেকটাই কম। আর বাঁধাকপিটা শীতকালীন সবজি হওয়ায় সে সময় উৎপাদন বেশি হয়। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেন, এ জন্য অন্যান্য জেলার বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কৃষিপণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে কুষ্টিয়া প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলেও জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে