শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাভাইরাস

নাজুক 'লকডাউনে' বিস্তার ঠেকছে না

বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সব বন্ধ করে দিলেও তা যে বিশেষ কাজে লাগেনি, তা পাওয়া যায় বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সংক্রমণের চিত্রে। অর্থাৎ বেশি রোগী পাওয়ায় যে স্থানগুলোকে 'ক্লাস্টার' বলা হচ্ছিল, সেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে মানুষ ছড়িয়ে পড়ায় ছোঁয়াচে এই রোগও ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন এলাকায়
যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ মে ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০৩ মে ২০২০, ১০:৪৫
করোনা সংক্রমণে বন্ধ রয়েছে দেশের সব কিছু। কিন্তু পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় সড়কগুলোতে ভিন্ন চিত্র। যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে লকডাউন চলছে। নানা ভোগান্তি উপেক্ষা করে এখনো ঢাকায় ফিরছেন শ্রমিকরা। ছবিটি শনিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দেড় মাসের বেশি সময় পরও রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা ছিল কোভিড-১৯ মুক্ত। গত ৩০ এপ্রিল এই উপজেলায় করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী ধরা পড়ার পর জানা যায়, ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। অথচ এর এক মাস আগে থেকে লকডাউন চলছে দেশে; গণপরিবহণ বন্ধ। কক্সবাজার জেলায় এপ্রিলের শুরুতে কোনো রোগী ছিল না। সংক্রমণ ঠেকাতে গত ৮ এপ্রিল অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল এই জেলা। অথচ বুধবার নাগাদ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবর রহমান জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ তাবলিগফেরত মুসলিস্ন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার নাগাদ শরীয়তপুর জেলায় মোট ২৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ব্যক্তি এবং তাদের সংস্পর্শে আসারাই প্রধান। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সব বন্ধ করে দিলেও তা যে বিশেষ কাজে লাগেনি, তা পাওয়া যায় এ রকম বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সংক্রমণের চিত্রে। অর্থাৎ বেশি রোগী পাওয়ায় যে স্থানগুলোকে 'ক্লাস্টার' বলা হচ্ছিল, সেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে মানুষ ছড়িয়ে পড়ায় ছোঁয়াচে এই রোগও ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন এলাকায়। অথচ এটা ঠেকাতেই দেয়া হয়েছিল ছুটি, তৈরি করা হয়েছিল অবরুদ্ধ অবস্থা। তাহলে কেন সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না- এই প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেন, মানুষ নানা কৌশলে বের হচ্ছে, ফলে তারাও পেরে উঠছেন না। অনেটা অসহায় কণ্ঠে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, 'চার থেকে ছয় হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান এই জেলায় ঢুকছে এবং বের হচ্ছে। এসব গাড়িতে যদি একজন করে লোক নেয়, তাহলে কতজন হয়? এটা কিভাবে রোধ করা যাবে?' ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো এলাকায় প্রতিদিনই ঢুকছে ও বের হচ্ছে অনেকে। অথচ এই তিন জেলায়ই দেশের অর্ধেক রোগী। শুধু ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই নারায়ণগঞ্জে প্রতিদিন ৪-৬ লাখ লোক এখনো আসা-যাওয়া করে। পরিস্থিতি দেখে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র 'কারফিউ' ঘোষণার আরজি জানিয়েছিলেন। এরপর অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও চলাচল ঠেকানো যায়নি। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল বলেন, কাগজ-কলমে ৩০ লাখ বাসিন্দার এই জেলার ভৌগলিক সীমারেখা জটিল। সড়ক ও নৌপথে যে কেউ যেকোনো স্থান দিয়ে বের হতে পারে। এ রকম অন্তত ৫০টি জায়গা রয়েছে, সেসব স্থান দিয়ে মানুষ অন্য জেলায় আসা-যাওয়া করতে পারে। তিনি বলেন, 'পুলিশ দিনরাত পালা-বদল করে ২২ পয়েন্টে ডিউটি দিচ্ছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষকে আটকায় এবং পথ ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু ৯ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার ট্রাক তো ভেতরে ঢুকছে এবং বের হচ্ছে জরুরি প্রয়োজনে।' তিনি বলেন, এই জেলায় তৈরি খাদ্যপণ্য সারাদেশে যায়। এ জন্য ৬০০ কারখানা খোলা রয়েছে, এ জন্য ৪-৬ লাখ মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। এই জেলা থেকে আটা, চাল, ডাল, গুঁড়ো দুধ, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এ ছাড়াও মেগা প্রকল্পের জন্য সিমেন্ট তৈরি হয় এই জেলায়। পুলিশ সুপার বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ শুধু শিল্পনগরী নয়, একটি বন্দরনগরীও। এই জেলার স্বীকৃত ৩০টি ঘাট থাকলেও আরও ছোট ছোট অনেক ঘাট রয়েছে। পুলিশ এই ৩০টি ঘাট মনিটরিং করে। কিন্তু আনাচে-কানাচে দিয়ে রয়েছে অনেক পথ।' একই পরিস্থিতির কথা বলেন ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারাও। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে মানুষ কীভাবে বের হচ্ছে- জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, 'ভেঙে ভেঙে অনেকে অনেক কারণ দেখিয়ে বের হয়, জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে। অনেকে রাতে অ্যাম্বুলেন্সে ও ট্রাকে করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বের হয়। পুলিশ অনেককে ধরেও। উল্টোপথে ঘুরিয়েও দেয়। আইনগত ব্যবস্থাও নেয়। কিন্তু এরপরও মানুষ নানা কৌশল অবলম্বন করে।' গাবতলীতে দায়িত্ব পালন করে আসা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'অটোতে কিংবা গাড়িতে এসে চেক পোস্ট দেখলে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ফুটপাত দিয়ে পার হয় মানুষ। চেক পোস্ট পার হওয়ার পর আবার গাড়িতে উঠে পড়ে।' 'এ রকম কিছু ধরা পড়ে, কিন্তু কত ধরা যায় বলুন?' বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। দেশে প্রথম রোগী ধরা পড়ার দুই মাস পর এখন রোগীর সংখ্যা যখন বেশি বাড়ছে, তখন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিকের বিচরণে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি আরও বেড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা 'লাগামহীনভাবে' বাড়া দেখে ঢাকার সাভারের সব পোশাক কারখানা বন্ধ করতে গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, কারখানা খোলা রেখে কোনোভাবেই সংক্রমণের গতি কমানো যাবে না। বাংলাদেশে এখন আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২৩৮। দুদিন আগে দেশে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬৪১ জন নতুন রোগী ধরা পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে যখন অবরুদ্ধ অবস্থা আরও কড়াকড়ি করা দরকার ছিল, তখন পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে হতাশ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকা আইসিডিডিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, 'ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের মতো এলাকা থেকে মানুষজনের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অবশ্যই সংক্রমণ অনেক কমানো যেত।' এখন আরও কড়াকড়ির সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, 'গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে কনটেইনমেন্টের জোন করা দরকার, যাতে ওই এলাকায় কেউ প্রবেশ বা বাহির হতে না পারে। পুরো কারখানা এলাকাগুলোকে এভাবে ছোট ছোট জোনে ভাগ করে কনটেইনমেন্টের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কর্মীরা লক্ষণ গোপন করে থাকলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।' 'এ ব্যবস্থা করতে পারলে শ্রমিকসহ অন্যরা এলাকা ছেড়ে যেতে বা কেউ ওই এলাকায় প্রবেশ করতে না পারলে এমনিতেই লকডাউন কড়াকড়ি হবে,' বলেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে