বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা আসছে

আহমেদ তোফায়েল
  ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

হ ছয় মাসের সুদ মওকুফের পরিকল্পনা

হ দুই-একদিনের মধ্যে সার্কুলার জারি

বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশজুড়ে যখন চলছে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি। মাঠজুড়ে যখন গ্রীষ্মকালীন সবজির সমাহার, ঠিক সেই সময় অঘোষিত লকডাউনে দেশ। ফলে বাজারে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা নেমেছে এক-তৃতীয়াংশে। গ্রাম থেকে শহরে সবজি ও অন্যান্য কৃষিপণ্য আসার পরিমাণ কমে গেছে। এতে সবজি উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে মাথায় হাত উঠেছে কৃষকের।

একদিকে যেমন দাম না থাকায় ক্ষেত থেকে সবজি তোলায় আগ্রহ পাচ্ছেন না কৃষক। অন্যদিকে কষ্টে ফলানো সবজি নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতেই। অর্থনীতিবিদ ও কৃষক নেতারা বলছেন, আগামী ২ সপ্তাহ এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের কৃষি ও কৃষক বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। ভেঙে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কৃষকের জন্য কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার বেলআউট প্যাকেজ বা প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, করেনাভাইরাসের কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বড় সংকটে পড়েছেন। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্যান্য খাতের মতো কৃষকদেরও প্রণোদনা দেয়া হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের জন্য একটি প্যাকেজ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সূত্র বলছে, যদিও কষকদের জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তবে এটি পাঁচ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার কারণে কৃষকরা কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তা তাদের নিরূপণ করা সম্ভব এখনো হয়নি। তবে খুব দ্রম্নত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দুই/একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হবে।

সূত্রটি জানায়, এ সময়ে কৃষকদের ৩ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যা বিদ্যমান সুদের হারের ৯ শতাংশ। প্যাকেজটি বাস্তবায়নের জন্য একটি রিফাইন্যান্সিং তহবিল গঠন করা হবে। যেখান থেকে ব্যাংকগুলো ৫ শতাংশ সুদে তহবিল পাবে। তারা ৩ শতাংশ কৃষকদের ঋণ দেবে। আর ২ শতাংশ সরকার ব্যাংকগুলোকে সরকার ভর্তুকি দেবে। পুনঃঅর্থায়ন তহবিলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিলের সমন্বয়ে গঠিত হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খসড়া গাইডলাইন অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলোকে দুই শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হবে। তহবিলটির মেয়াদ হবে এক বছর। তবে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এটি বাড়ানো হতে পারে।

খসড়া নীতিমালা অনুসারে, পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে বিতরণকৃত ঋণ ব্যাংকগুলোর বার্ষিক কৃষিঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে যোগ করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) কৃষিঋণ বিতরণের জন্য ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রতিটি ব্যাংকে প্রতি বছর তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২ দশমকি ৫ শতাংশ কৃষকদের ঋণ দিতে হয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ছয় মাসের জন্য কৃষকদের সুদ মওকুফ করার পরিকল্পনা করেছে। তবে ব্যাংকগুলো তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিলের সঙ্গে সুদের টাকা সমন্বয় করে নেবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে কৃষকদের আয়ের উৎস এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের বেশিরভাগই দৈনিক রোজগারে জীবন-যাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কম সময়ের মধ্যেই প্যাকেজের কাজটি সম্পন্ন করা। যাতে লকডাউন ওঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা তাদের হাতে টাকাটা পেতে পারেন।

এদিকে কৃষকের পণ্য বিক্রির প্রভাব পড়েছে রাজধানীর পাইকারি বাজার ও আড়তে। কারওয়ানবাজার ও যাত্রাবাড়ী আড়তে আগে যেখানে দৈনিক ৪০০-৫০০ ট্রাক আসত এখন তা নেমে এসেছে ৫০টিতে। রাজধানীর বাজারগুলোতে বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে পাইকাররা যাচ্ছেন না আড়তে।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে যশোর থেকে শসা ও বেগুন এনেছেন রাজিব উলস্নাহ। দেশজুড়ে সাধারণ ছুটির আগে তিনি এই ২টি পণ্য ২০০-২৫০ মণ নিয়ে আসতেন। গতকাল নিয়ে এসেছেন মাত্র ৫০ মণ। তারপরও আগের মতো গ্রাহক পাচ্ছেন না। কিন্তু ঠিকই তার যশোরের আড়তে ৬ জন শ্রমিককে মজুরি দিচ্ছেন।

ঢাকায় পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে কাছের জেলা মানিকগঞ্জেও করোনার প্রভাব পড়েছে। সেখান থেকে কৃষিপণ্য আসা কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। ওই জেলায় মাঠে মাঠে ফসল তোলার জন্য প্রস্তুত থাকলেও কৃষি-শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। নগদ টাকার প্রয়োজনে কৃষক নিজেরা ফসল কেটে বাজারে আনলেও দাম পাচ্ছেন না। ফলে যেসব কৃষক অর্থকরী ফসল চাষ করেন তারা পড়েছেন সংকটে।

কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি এ টিএম ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন এ বাজারে কমপক্ষে ৩০০ ট্রাক সবজি কেনাবেচা হয়। কিন্তু গতকাল রাতে এখানে ১০০ ট্রাক সবজিরও কাটতি ছিল না। পাইকারি ব্যবসায়ী যারা বস্তায় বস্তায় সবজি কিনত তারা কয়েক কেজি করে সবজি কিনে পাড়া-মহলস্নায় খুচরায় বিক্রি করছেন। তারাও দিন পার করছেন কোনোমতে। সব মিলিয়ে এ খাতে নিয়োজিত ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনই কৃষককে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষক নেতারা। কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির চন্দন যায়যায়দিনকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সহায়তা দিচ্ছে, কৃষিতেও সে রকম ভর্তুকি দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের আট মাসে কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার ৯২ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে বিতরণ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার ৬৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংক তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে থাকে। কৃষক পর্যায়ে সুদের হার নিয়ে থাকে ৯ শতাংশ। যেসব ব্যাংকের পলস্নী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, ওইসব ব্যাংক নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণ করছে। আর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণে কৃষক পর্যায়ে সুদের হার মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরেটির (এমআরএ) বেঁধে দেয়া সুদহার সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ।

এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের গতকাল গাইডলাইন প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য কারখানার মালিকরা এ তহবিল থেকে স্বল্প সুদের ঋণ নিতে পারবেন।

উলেস্নখ্য, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের জন্য নতুন ৪টিসহ ৫টি প্যাকেজে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95687 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1