শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রাণ বিতরণে আত্মপ্রচারই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি

অনেকেই মানুষের বাসাবাড়িতে গিয়ে ত্রাণ দিলেও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। এতে সামাজিকভাবে বিব্রত হচ্ছেন করোনায় কর্মহীন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ
ফয়সাল খান
  ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

নিম্নআয়ের মানুষসহ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে সংকোচ বোধ করেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা অমান্য করে আত্মপ্রচারকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও সামাজিক সংগঠন জনসম্মুখে ত্রাণ বিতরণ করে তার ছবি ও ভিডিও করে রাখছে। অনেকেই মানুষের বাসা-বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ দিলেও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। এতে সামাজিকভাবে বিব্রত হচ্ছেন করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে জনপ্রতিনিধিসহ সামর্থ্যবান সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আলোকে দেশের সব জেলায় বিশেষ বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত আট হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল ও চার কোটি ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ফান্ড থেকে মাঠ প্রশাসনে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ অব্যাহত রেখেছে সরকার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অনুদানও অব্যাহত আছে।

তবে এসব অনুদান বিতরণের ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ছবি তোলা বা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা যেন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। রাতের বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়েও আত্মপ্রচারে ছাড় দিচ্ছেন না অনেকে। উপজেলা পর্যায়ে গভীর রাতে ত্রাণ দিতে গেলেও গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে যাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। আবার ওই ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের সাফল্য হিসাবে প্রচার করছেন তারা।

স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক দলের নেতারাও পিছিয়ে নেই। অসহায় মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকেই আবার যাকে সাহায্য দিচ্ছেন তারা নাম ঠিকানাসহ প্রচার করছেন। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে অনেকেই ত্রাণ নিতে চাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর এক বেসরকারি চাকরিজীবী যায়যায়দিনকে জানান, বনশ্রী এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। গত শুক্রবার বিকেলে বাজারে যান। বাজার থেকে এসে দেখেন বাসায় চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্যাকেট। তার স্ত্রী জানান কয়েকজন লোক এসে এগুলো দিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর নিজের স্ত্রীর ছবি ফেসবুকের একটি পেজে দেখতে পান। এতে করে সামাজিকভাবে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ওই পরিবার।

আলাপকালে তিনি জানান, অর্থিক সংকট চলছে এটা অস্বীকার করব না। তবে মানুষের কাছে হাত পাতার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। আমার অনুপস্থিতিতে যারা স্ত্রীর ছবি তুলে ফেসবুকে নিজেদের হিরো বানিয়েছেন তারা চরম অন্যায় কাজ করেছেন।

একই অবস্থা চলছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এমনো ঘটনা ঘটেছে, মধ্যরাতে একজন অসহায় মহিলাকে খাবার প্যাকেট পৌঁছে দিতে গিয়েও স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে গেছেন এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। নিজের কাঁধে বা মাথায় করে খাবার বস্তা বা ব্যাগ নিয়ে ওই ছবি আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন অনেক কর্মকর্তা।

বিভিন্ন জেলা, উপজেলার ফেসবুক পেজ, গ্রম্নপ বা আইডিতে ঢুকলে এমন অসংখ্য ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাবে যা কেবলমাত্র নিজেদের সাফল্য প্রচারের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এমন বেশকিছু কন্টেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ত্রাণ বিতরণের বিভিন্ন ছবি ভিডিও নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তারাও এর পেছনে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, কাউকে ছোট করার জন্য ছবি তোলা হচ্ছে না।

কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সরকার যে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তা বোঝানোর জন্য অনেক সময় প্রচার করতে হয়। এসব প্রচার না হলে সরকার যে মানুষকে সাহায্য করছে তা বোঝা যাবে না।

রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা মূলত দলীয় প্রধান, মন্ত্রী, মেয়র এমপি, ইউনিট সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ত্রাণ বিতরণের ছবি বা ভিডিও করে থাকেন। তাদের ভাষ্য, দলীয় প্রধান বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যাতে তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত থাকেন এজন্য ছবি তুলতে হয়। এছাড়া এসব ছবি ও ভিডিও নেতাকর্মীদেরও সংগঠনের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে। সকারারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে আত্মপ্রচারের হিড়িক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, ত্রাণ বিতরণ একটি মানবিক কাজ। তবে বর্তমানে এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে চরম নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের পাশে সবাই যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাতে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও এসব আত্মপ্রচার দেখে চরমভাবে হাতাশ হচ্ছি। অনেকেই রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য এই অবস্থাটাকে কাজে লাগাতে চাইছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে মানবিক চেতনার খুবই অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবাইকে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আত্মপ্রচারমূলক কার্যক্রম থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর অন্যতম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণার দরকার আছে। তবে তা হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে কেউ দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অমান্য করে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছবি বা ভিডিও অনেকের প্রমাণের জন্য কাজে লাগতে পারে। তাই বলে যেখানে সেখানে ছবি তুলে এভাবে আত্মপ্রচার করা ঠিক হচ্ছে না। এগুলো অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95443 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1