শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল

গাজীপুর প্রতিনিধি
  ২৭ জুন ২০১৮, ০০:০০
শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে সিল মারা ব্যালট পেপার Ñযাযাদি

গাজীপুরের ৯ নম্বর ওয়াডের্র এম এ আরিফ কলেজ কেন্দ্র্র্র্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদশীর্রা জানান, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কেন্দ্র্রের ১ নম্বর কক্ষে ঢুকে একদল তরুণ ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল দেয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে কেন্দ্র্রের ভেতর এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল।

কয়েকজন ভোটার জানান, যারা সিল মারেন তাদের প্রত্যেকের গলায় আওয়ামী লীগ প্রাথীর্ জাহাঙ্গীর আলমের পরিচয়পত্র ঝুলছিল। কেন্দ্র্রে ভোটগ্রহণ চলছে বোঝানোর জন্য ওই তরুণদের কয়েকজন সাধারণ ভোটারদের লাইনের সামনে দঁাড়িয়ে পড়েন। ভেতরে সিল মারার কাজ চলে।

জানতে চাইলে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পোলিং এজেন্ট বলেন, ‘আমার চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কিছু করার ছিল না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এরশাদ আলী কোনো মন্তব্য করেননি। প্রিসাইডিং অফিসার মাহমুদুল আলী বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা গুজব। মাত্র ৫-৬ মিনিট ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। ওই কেন্দ্র্রে ২ হাজার ১০ ভোট রয়েছে বলে তিনি জানান।

এদিকে গাজীপুরের পুবাইল আদশর্ কলেজ কেন্দ্র্রে সবার সামনেই জালভোট দেন এক ব্যক্তি। ভোটারের কাছে থাকা তিনটি ব্যালট পেপারের মধ্যে শুধু মেয়র পদের ব্যালট নিয়ে সিল দিয়ে বাক্সে ফেলছিলেন।

ওই ব্যক্তি নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী ছিলেন।

মঙ্গলবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিবার্চনে পুবাইল আদশর্ কলেজ কেন্দ্র্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারের হাত থেকে মেয়র পদের ব্যালট পেপার টেনে নিয়ে কেন্দ্র্রের ভেতর এক বহিরাগত ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেই নৌকা প্রতীকে সিল মারছিলেন।

‘আপনি কেন সিল মেরে দিচ্ছেন’- এমন প্রশ্নে বুথ থেকে দ্রæত বেরিয়ে যান ওই ব্যক্তি।

এ ঘটনায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন ওই কেন্দ্র্রের সহকারী প্রিসাইডিং কমর্কতার্। ওই কেন্দ্র্রে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টরা নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের কাছ থেকে ভয়ভীতি প্রদশর্ন ও হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। তাদের প্রায় সবাইকে গলায় ঝুলিয়ে রাখা কাডর্ প্রদশর্ন না করে শাটের্র নিচে, পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রের কাছে ধানের শীষের নিবার্চনী ক্যাম্পেও নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের বসে থাকতে দেখা গেছে। সেখানে ধানের শীষের এজেন্টদের দেখা যায়নি।

গতকাল সকাল থেকে পুবাইলের বসুগঁাও এলাকায় পুবাইল আদশর্ কলেজ কেন্দ্র্রে নারী ও পুরুষ ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়ে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দেখা যায়, মোট আটটি বুথে পুরুষ (১-৪) ও নারী (৫-৮) ভোটাররা সারিবদ্ধভাবে দঁাড়িয়ে ভোট দিতে অপেক্ষা করছেন। নারীদের জন্য চারটি ও পুরুষদের জন্য চারটি বুথে ভোট নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৭ নম্বর বুথে বিএনপির কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। বাকি বুথগুলোয় দায়িত্ব পালন করা বিএনপির এজেন্টরা অভিযোগ করেন, সকাল থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী লোকজন তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে ১ নম্বর বুথে (পুরুষ) গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সব দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রাথীের্দর এজেন্ট রয়েছেন। এর বাইরে ব্যালট বাক্সের সামনে সাদা টি-শাটর্ পরা এক ব্যক্তি দঁাড়িয়ে আছেন। ভোটারের হাতে সহকারী প্রিসাইডিং কমর্কতার্ মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর পদের জন্য তিনটি ব্যালট পেপার তুলে দেওয়ামাত্র সাদা টি-শাটর্ পরা ব্যক্তি ব্যস্ততার সঙ্গে ভোটারের হাত থেকে শুধু মেয়র পদের ব্যালট পেপার টেনে দেন এবং সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ভরে দেন। বাকি দুটো ব্যালট পেপারে ভোটার নিজেই ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

এই প্রতিবেদক ওই ব্যক্তিকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ‘আপনি কে? আপনি কেন ভোট দিচ্ছেন’-জিজ্ঞেস করা মাত্র কোনো জবাব না দিয়ে তিনি দ্রæত ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।

এ নিয়ে ওই বুথে দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং কমর্কতার্ সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারবার মানা করার পরও তিনি এ কাজ করছেন।’

সাদা টি-শাটর্ পরা ব্যক্তিকে এরপরও কেন্দ্র্রে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।

এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ওই কেন্দ্র পরিদশের্ন আসেন সহকারী রিটানির্ং কমর্কতার্ নাজমুল ইসলাম। তাকে এই ঘটনা জানানো হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এখন পযর্ন্ত কোনো অনিয়ম পাননি। কোনো বুথে বহিরাগত কেউ থাকতে পারবেন না। ওই সময় তিনি নিবার্চনের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের বুথ থেকে বহিরাগত লোক থাকলে বের করে দেয়ার নিদের্শ দেন।

বুথের ভেতরে নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের ফোন ব্যবহারের অভিযোগ করা হলে তিনি সবার ফোন ফেরত নেয়ারও নিদের্শ দেন।

বেলা ১১টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট কেন্দ্র পরিদশের্ন আসেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী রিটানির্ং কমর্কতার্ পরিদশর্ন শেষে কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বহিরাগত লোকজন প্রায় সব কটি বুথে ঢুকে পড়ে প্রকাশ্যে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলতে থাকেন।

আটটি বুথের বেশির ভাগের নৌকা প্রতীকের এজেন্ট না হয়েও নৌকার ব্যাজধারী বহিরাগত ব্যক্তিদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। এবার তারা ভোটারের হাত থেকে নয়, সরাসরি সহকারী প্রিসাইডিং কমর্কতার্র কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মারতে থাকেন। তবে তারা শুধু মেয়র পদের সাদা রঙের ব্যালট পেপারই নেন। ভোটারের নাম জিজ্ঞেস করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ভরতে দেখা যায় তাদের। প্রতিটি বুথে এমন একাধিক ব্যক্তি এই সিল মারার কাজ করেছেন।

৮ নম্বর বুথে গিয়ে দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন নৌকা প্রতীকে সিল মারছেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানালেন. নাম মো. আশরাফুল আলম। গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। বাসা পুবাইলে। বললেন, ‘নৌকার জন্য এটুকু কাজ করতে হয়।’

ওই বুথেই ধানের শীষ প্রতীকের কাডর্ ঝুলিয়ে এক ব্যক্তিকে জালভোট দিতে থাকা আশরাফুল আলমের সঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানান, নাম সাকিব হোসেন। এই কেন্দ্র্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট মোবারক মোল্লার কাছ থেকে ধানের শীষের এই কাডির্ট পেয়েছেন বলে জানালেন।

৬ নম্বর বুথে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি পরা একজন নৌকা প্রতীকে ব্যালট পেপারে সিল মারছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, নাম মো. রাসেল। পুবাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। এবার ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রাথীর্।

ওই কেন্দ্র্রের প্রিসাইডিং কমর্কতার্ শেখ মোহাম্মদ আতাউল্লাহকে ওই সময় বুথ থেকে বুথে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। তিনি বহিরাগত ব্যক্তিদের বের করে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি এক বুথ থেকে বের করে অন্য বুথে যাওয়া মাত্র বহিরাগত ব্যক্তিরা ফের ঢুকে জালভোট দেয়া শুরু করেন।

ধানের শীষের নিবার্চনী

ক্যাম্পেও নৌকার এজেন্ট

পুবাইল আদশর্ কলেজ কেন্দ্র্রের উল্টো দিকে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রাথীের্দর নিবার্চনী ক্যাম্প রয়েছে। কাউন্সিলর প্রাথীের্দর মধ্যে করাত ও ঠেলাগাড়ি মাকার্ আর মেয়র পদে ধানের শীষ ও নৌকা প্রতীকের আলাদা ক্যাম্প রয়েছে সেখানে। সেসব ক্যাম্প থেকে ভোটারদের হাতে যার যার প্রতীকের ছাপ দেয়া ভোটার নম্বরের চিরকুট দেয়া হচ্ছিল। ধানের শীষের প্রতীকের ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিএনপির মেয়র প্রাথীর্ হাসান উদ্দিন সরকারের ব্যানার ও পোস্টার থাকলেও তার কোনো এজেন্ট নেই। ধানের শীষের এজেন্টদের বদলে সেখানে আওয়ামী লীগ প্রাথীর্ জাহাঙ্গীর আলমের ছবিসহ নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী চারজন ভোটার চিরকুট বিতরণ করছেন। তাদের একজনের কাছে বিএনপির ক্যাম্পে বসে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘বিএনপির কোনো এজেন্ট এখানে বসেননি। ফাকা পেয়ে আমরা বসেছি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে