শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হরিণ পালনে অভাবনীয় সাফল্য, বাধা নীতিমালা

যাযাদি ডেস্ক
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
মৃদুল হালদারের খামারে চিত্রা হরিণ -যাযাদি

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পর সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীটি চিত্রা হরিণ। যাকে কখনো চিত্রল হরিণ, চিত্র মৃগ, চিতল নামে ডাকা হয় স্থানীয়ভাবে। উপমহাদেশীয় হরিণ প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এই চিত্রা হরিণ। এদের মায়াবি চাউনি সত্যিই চিত্তাকর্ষক।

চিত্রা হরিণ বিভিন্ন পার্ক কিংবা চিড়িয়াখানায় দেখা গেলেও খামারি পর্যায়ে পালনের কথা শোনা যায়নি কখনো। কিন্তু সেই অসাধ্য কাজটি করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের জেমস মৃদুল হালদার।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরের এই গ্রামে গড়ে উঠেছে বিভাগের একমাত্র চিত্রা হরিণের খামারটি। বলা চলে, বরিশাল বিভাগের একমাত্র গ্রাম যেখানে এখন চিত্রা হরিণের পদচারণায় মুখর।

লাজুক স্বভাবের অথচ চঞ্চল প্রকৃতির এ হরিণের দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো দেখতে প্রতিনিয়ত এ খামারে আসছেন অসংখ্য মানুষ। তবে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ পালনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন এই খামারি।

২০১০ সালে রাজিহার ইউনিয়নের রাজিহার গ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আলো-শিখার পরিচালক জেমস মৃদুল হালদার শখের বশে ব্যক্তিপর্যায়ে দুটি চিত্রা হরিণ পালন শুরু করেছিলেন। শুরুতে তিনি একটি পুরুষ ও একটি মেয়ে চিত্রা হরিণ রাজশাহী থেকে কিনে আনেন। কিন্তু রাজশাহী থেকে আনা হরিণ দুটি এক সপ্তাহের মাথায় মারা যায়। তবে কিছুদিন পরেই হরিণ পোষার নেশায় বগুড়ার শিয়ালী গ্রামের এক খামারির কাছ থেকে মৃদুল সাহা আরও দুটি হরিণ কিনে আনেন। পরিবহণ খরচসহ ওই দুটির দাম পড়ে প্রায় লাখ টাকা।

এর কিছুদিন পর হরিণ বাচ্চা প্রসব করে এবং বছরে বছরে হরিণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ব্যক্তিপর্যায়ে হরিণ পালার শখ গিয়ে ঠেকে খামারিতে। আর সেই খামারে গেল প্রায় ১০ বছরে কখনো ২০, কখনো ২৫ কিংবা কখনো এর চেয়েও বেশি হরিণ বিচরণ করে বেড়িয়েছে একসঙ্গে। তবে এ বছর খামারে রয়েছে ১৬টি হরিণ।

খামারির মালিক জেমস মৃদুল হালদার জানান, চিত্রল হরিণ পোষা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০০৯ অনুমোদনের পর শখের বশে হরিণ পালার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ২০১০ সালে দুটি হরিণ সংগ্রহ ও পালন শুরু করি। কয়েকমাস পরেই সে হরিণ দুটি বাচ্চা প্রসব করলে ভালোলাগা বেড়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে ব্যক্তিপর্যায় থেকে খামারি পর্যায়ে চলে যাই। অর্থাৎ, ১০টির বেশি হয়ে যায় হরিণের সংখ্যা। বর্তমানে খামারে ১৬টি হরিণ রয়েছে, তবে ২০১৮ সালে ২৬টি হরিণ ছিল খামারে। ৮টি দান করা হয়েছে এবং ২টি মারা গেছে।

রোগবালাইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, হরিণের তেমন কোনো রোগবালাই নেই, তাই পালনটা সহজ। শুধু হরিণের হার্টঅ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি থাকে, তারপরেও গেল প্রায় ১০ বছরে আমার খামারে মাত্র দুটি হরিণ মারা গেছে। আবার আমার কাছ থেকে হরিণ নিয়ে গাজীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জের তিনজন হরিণ পালন শুরু করেছেন। তার মধ্যে গাজীপুরের হরিণগুলো দুটি বাচ্চাও দিয়েছে। আবার বরিশালের দুর্গাসাগরে দর্শনার্থীদের জন্য দুটি হরিণ আমার এই খামার থেকেই দান হিসেবেই দেওয়া।

খাবারসহ আনুষঙ্গিক খরচের বিষয়ে তিনি জানান, হরিণ সব কিছু খায় না। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া চিত্রা হরিণ অন্য কোনো পানি পান করে না। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে গমের ভুসি, ডালের ভুসি, গুঁড়া সয়াবিন, মালঞ্চ-কলমি পাতা। এছাড়া কেওড়া ফল ও বাঁধাকপিও খেতে দিচ্ছি হরিণগুলোকে।

লালন-পালনে বিশেষ নজর রাখতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য আলাদা লোক রাখতে হয়েছে। ৪০ শতাংশ জমির ওই খামারটিতে মাঠের বাইরে আলাদা বসার ঘর করতে হয়েছে হরিণের জন্য। সুন্দরবন ছাড়া এ অঞ্চলে কেওড়া গাছ পাওয়া যায় না, সেই গাছ আমাকে লাগাতে হয়েছে।

খাওয়াদাওয়া ও পরিচর্যায় গেল প্রায় ১০ বছরে বহু পুঁজি খেটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক অনুমোদন অর্থাৎ হরিণ বিক্রির অনুমোদন না দেওয়ায় এ খাতে এখনো কোনো আয় নেই। তবে হরিণ যে দান করা হয় সেখান থেকে উপহার হিসেবে অনেকেই টাকাপয়সা দেন।

তিনি বলেন, প্রতিমাসে লালন-পালনে হরিণগুলোর পেছনে বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ আছে, আর এ খরচ শুধু শখের বশে পালন করি বলেই বহন করছি। যদিও পালন করে বড় করা একটি হরিণ জবাই করে এর মাংস খাওয়াটাও মুশকিল। কারণ এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ (বয়স্ক কিংবা অসুস্থতা) দেখিয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবহিত করে অনুমতি আনতে হয়।

এর বাইরে হরিণের বাচ্চা হলেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হয়। প্রতি বছর একেকটি হরিণের জন্যে আগে ১শ টাকা করে দিতে হলেও ২০১৮ সাল থেকে ১ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে সরকারকে। এছাড়া ১৫ শতাংশ ভ্যাট। নতুন লাইসেন্স করা, নবায়ন করা সবকিছু মিলিয়ে দিন দিন খরচ বাড়ছে।

হরিণ বন্যপ্রাণী হলেও গবাদি পশুর মতো পোষ মানে জানিয়ে মৃদুল হালদার বলেন, আমার খামারে সর্বোচ্চ ৭ বছর বয়সি আর সর্বনিম্ন ২ মাস বয়সি হরিণ রয়েছে। যার মধ্যে অনেকগুলোই গৃহপালিত প্রাণীর মতো কাছে আসছে, তাদের শরীরে হাত দেওয়া যাচ্ছে, আদর করা যাচ্ছে। তবে বেশি মানুষ দেখলে হরিণগুলো একটু ঘাবড়ে যায়, তাই বাধ্য হয়েই খামারের সীমানা প্রাচীরে দুটি স্তর করতে হয়েছে। তবে সবমিলিয়ে শৌখিন হলেও হরিণ পালন করা খুবই সহজ।

জেমস মৃদুল হালদারের দাবি, যেহেতু চিত্রা হরিণ পোষ মানে, সে কারণে বিলুপ্তি ঠেকাতে গবাদি পশুর মতো এর খামারের অনুমোদন দেওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া উচিত সরকারের। তা না হলে যে হারে দেশে বনভূমি কমে আসছে, তাতে চিত্রা হরিণ একদিন সত্যি সত্যিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, খামারের অনুমোদনের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া উচিত। কারণ প্রাণিসম্পদ বিভাগের চিকিৎসকরা হরিণের রোগবালাই সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। আবার একটা হরিণ ধরার জন্য গাজীপুর নয়তো ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে লোক আনতে হয়। সে ক্ষেত্রে এসব সমস্যার সমাধানে অঞ্চলভিত্তিক জনবল নিয়োগও দেওয়া উচিত।

সবকিছু মিলিয়ে হরিণ যাতে সবাই পালন করতে পারে সেজন্য নীতিমালা শিথিল করা, ট্যাক্স কমানো এবং লাইসেন্স গণহারে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

প্রাণিবিজ্ঞানী ও সরকারি ফজলুল হক কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান ড. অধ্যাপক গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কুকুর-গরু-ছাগল সবকিছুই সভ্যতার বিবর্তনে একটি নিয়মের মধ্যে থেকে আজ পোষ্য ও গৃহপালিত। তেমনি হরিণ যদি পোষ মানে সেটা অবশ্যই ভালো। তবে এর আগে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রয়োজন। হুট করেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যাবে না। এজন্য বিস্তর গবেষণা, আলোচনা ও সময়ের প্রয়োজন।

তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হরিণ পালন কিংবা খামার করার বিধিবিধান এখন অনেক সহজ করা হয়েছে বলে দাবি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90124 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1