শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার টানে শূন্যরেখায় দুই বাংলার মিলনমেলা

যাযাদি ডেস্ক
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:১২
কাঁটাতারের বিভেদ ভুলে শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বেনাপোল সীমান্তের শূন্যরেখায় একুশ উদযাপন -যাযাদি

বেনাপোল সীমান্তের শূন্যরেখায় একুশে উদযাপন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষার টানে দুই বাংলার হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী এক হয়ে যান। কাঁটাতারের বিভেদ ভুলে সীমান্তের শূন্যরেখা যেন পরিণত হয় দুই বাংলার মিলনমেলায়। শুক্রবার একসঙ্গে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে, বুক মিলিয়ে, কথা বলে, গান গেয়ে বাংলা ভাষাভাষী এক জাতিতে পরিণত হন দুই রাষ্ট্রের বাসিন্দারা। ভৌগোলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে শুক্রবার সকালে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে দলে দলে মানুষ যোগ দেন একুশের মিলনমেলায়। বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে অস্থায়ী শহিদ বেদি দুই বাংলার মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়। এবার দুই দেশ আলাদাভাবে মঞ্চ তৈরি করে এই মিলনমেলার আয়োজন করে। দুই বাংলার সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সরকারের প্রতিনিধিরা সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' এই গানের সুরে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত করতে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিলিত হন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বেনাপোল-পেট্রাপোল নো ম্যান্স ল্যান্ডে অস্থায়ী শহিদ বেদিতে ফুল দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে মঞ্চে সভাপতিত্ব করেন ৮৫ যশোর-১ শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন। সীমান্তে নানা রঙের ফেস্টুন, ব্যানার, পস্ন্যাকার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় নো ম্যান্স ল্যান্ড এলাকা। দুই বাংলার ভাষাপ্রেমীরা একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে তারা পরস্পরকে বরণ করে নেন। অনুষ্ঠানে উভয় দেশের শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন ও আবৃত্তি করেন। পুরো অনুষ্ঠানে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ ছিল সর্বদা সতর্কাবস্থায়। অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয় দুই সীমান্তে। ভাষা দিবসের মিলনমেলায় বিজিবি-বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। এরপর দুই দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে। এই নো ম্যান্স ল্যান্ডের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, বিশেষ অতিথি ছিলেন যশোর-১ শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন, বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী, যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ, যশোরের পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেন, বেনাপোল বন্দরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) আব্দুল জলিল, যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. সেলিম রেজা, শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূলক কুমার মন্ডল, যশোর জেলা আ'লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ২১ উদযাপনের সদস্যসচিব নূরুজ্জামান, বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ওসি আহসান হাবিব, বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান প্রমুখ। পশ্চিম বাংলার মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মলিস্নক, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বনগাঁর পৌর প্রধান শংকর আঢ্য, বনগাঁ লোকসভার প্রাক্তন সংসদ সদস্য মমতা ঠাকুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি বীনা মন্ডল, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি কৃষ্ণ গোপাল ব্যানার্জি, বনগাঁ পৌরসভার প্রাক্তন পৌরমাতা জ্যোৎন্সা আঢ্য, বনগাঁ পৌরসভার উপ-পৌরমাতা কৃষ্ণা রায়, বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রদীপ বিশ্বাস, উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা শাসক চৈতালি চক্রবর্তী, বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার, ১৭৯ বিএসএফের সহকারী কমান্ডার শিব নারায়ণ, পেট্রাপোল স্থলবন্দরের সহকারী কাস্টমস কমিশনার মিহির কুমার চন্দ, পেট্রাপোল থানার ওসি কার্তিক অধিকারীসহ প্রমুখ। সভায় স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, '৫২-এর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। সে জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।' স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, 'এ দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। দুই দেশের নেতৃত্বে এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা হবে। ভাষা ও ভাষাশহিদদের প্রতি তাদের ভালোবাসা আমাদের দুই দেশের মধ্যে উপস্থিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিতকে আরও শক্ত করবে।' পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মলিস্নক বলেন, 'আপনারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কারোর নেই। এ জন্য আপনারা গর্বিত জাতি। ভাষার টানে আমরা বাংলাদেশে ছুটে এসেছি একুশ উদযাপন করতে। দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলার মধ্য দিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় হবে। আমার এসেছি অন্তরের টানে। বার বার ছুটে আসি। দেশ বিভক্তি হলেও ভাষার পরিবর্তন হয়নি। আমরা ওপারে থাকলেও শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ সব ভাষাসৈনিকের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।' এদিকে দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় হিলি সীমান্তের চেকপোস্ট গেটের শূন্যরেখায় বিজিবি ও বিএসএফের উপস্থিতিতে ভারতের পক্ষে ভারতের উজ্জীবন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সুরুজ দাস ও বাংলাদেশের পক্ষে হাকিমপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার লিয়াকত আলি ও সাপ্তাহিক 'আলোকিত সীমান্ত'র সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সেখানে দুই দেশের শিল্পীরা কবিতা আবৃতি ও গান পরিবেশন করেন। এর পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভাষাশহিদদের স্মরণ করা হয়। এ সময় সেখানে হাকিমপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুর রেজা শাহীন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান লিটন, ভারতের জয়েন্ট মুভমেন্ট করিডোরের আহ্বায়ক নবকুমার দাশ, মুক্তিযোদ্ধা সামসুল ইসলামসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। উজ্জীবন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সুরুজ দাস, করিডোরের আহ্বায়ক নবকুমার দাশ বলেন, 'দুই দেশের বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ আয়োজনে ষষ্ঠ বছরের মতো একত্রে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। তবে গতবারের মতো জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে না পারায় কিছুটা দুঃখ লাগছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দুই দেশকে বিভাজন করতে পারলেও আমাদের মন, আত্মা ও ভাষাকে বিভাজন করতে পারেনি। এপার বাংলা-ওপার বাংলা নয়, বাংলা অমর হোক সব বাঙালি তথা সারা বিশ্বের কাছে।' হাকিমপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুর রেজা শাহীন বলেন, 'গত বছরে দুই বাংলা একসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে উদযাপন করলেও এবারে নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। তবে আগামীতে আবারও এক সঙ্গে দুই দেশ মিলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করবে। আমাদের যে ধারাবাহিকতা সেটি অব্যাহত রয়েছে ও থাকবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে