শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ নয়, বিলাসী বাড়ি নির্মাণেই ঝোঁক প্রবাসীদের

মো. নূরুল হক কবির, হবিগঞ্জ
  ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
হবিগঞ্জের বিলাসবহুল বাড়ি

হবিগঞ্জের প্রবাসী অধু্যষিত নবীগঞ্জ উপজেলার লন্ডনী পাড়া হিসেবে খ্যাত ইনাগঞ্জ ও কুর্শি ইউনিয়নের নৌমৌজা। নৌমৌজার বিভিন্ন গ্রামে গেলে চোখে পড়ে অনেকগুলো বিলাসবহুল বাড়ি। কিন্তু সেগুলোতে থাকার কোনো মানুষ নেই। বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য রয়েছেন কেয়ারটেকার। কেয়ারটেকারের থাকা খাওয়া-ব্যবস্থা করে দিতে হয় তাদের। কারো বাড়িতে বসত গড়েছে পোকা-মাকড়।

প্রত্যন্ত পলস্নীতে এই বাড়িগুলো তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সর্বনিম্ন ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে ৫ কোটি টাকা। শত কোটি টাকা ব্যয়েও নির্মাণ হয়েছে বাড়ি। এমন তথ্যই জানিয়েছেন ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল হান্নান। দেশে বিনিয়োগ না করে বাড়ি নির্মাণ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, বিনিয়োগ করলে বিভিন্ন হয়রানির সম্ভাবনা থাকে। তাই বিনিয়োগ করেননি। আর বাড়ি বানিয়েছেন যাতে লোকজন তার নাম বলে।

রাজবাড়ীর পাশেই একই গ্রামে নান্দনিক আরেকটি বাগানবাড়ি রয়েছে। বোরহানপুর গ্রামের শিল্পপতি মেহবুব নুরুল ইসলাম ২০০০ সালে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অট্টালিকা বাড়ি নির্মাণ করলেও সেখানে থাকার কেউ নেই। মাঝে-মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে আসলে কিছুদিন বসবাস করে আবার লন্ডনে চলে যান। তবে এই বাড়ির দেখাশোনার জন্য লোক থাকলেও অবহেলা অযত্নে বাড়িতে থাকা দামি দামি আসবাবপত্র ও মূল্যবান জিনিস নষ্ট হচ্ছে।

এক সময় প্রবাসীরা দেশে জমি ক্রয় করতেন বলে জমির দাম ছিল বৃদ্ধির দিকে। আর এখন প্রবাসীরা জমি বিক্রয় করে বিকল্প পথে সেই টাকা নিয়ে যান বিদেশে। এতে করে কমছে জমির দাম। আর এভাবে দেশের সাথে শিকড় ছিন্ন করে ফেলায় রেমিটেন্স কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এখনও যারা দেশে টাকা প্রেরণ করেন তারা সেই টাকায় গড়ে তুলছেন বিলাশবহুল বাড়ি। যারা একটু শহরমুখী তারা গড়ে তুলছেন বিশাল মার্কেট। ফলে তাদের এই প্রেরিত অর্থ উৎপাদনে কাজে আসছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান।

হবিগঞ্জ, নবীগঞ্জসহ বৃহত্তর সিলেটের সকল পৌর এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে বড় বড় মার্কেট আর শপিংমল। এসব মার্কেটের অধিকাংশই নির্মাণ করেছেন প্রবাসীরা। হবিগঞ্জ শহরের আমীর চাঁন কমপেস্নক্স, আশরাফ জাহান কমপেস্নক্স, আব্দুল আলী কমপেস্নক্স, মহসিন মার্কেটসহ বেশ কিছু মার্কেট গড়ে তুলেছেন লন্ডন প্রবাসীরা। এখন চলছে আরও কয়েকটি মার্কেট নির্মাণ কাজ।

হবিগঞ্জ শহরের আমীর চান কমপেস্নক্সের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম জানান, বিচ্ছিন্নভাবে জমি কিনে রাখার চেয়ে মার্কেট নির্মাণে ঝুঁকি কম। আর বিনিয়োগ করতে গেলে শত শত বাধা। তাই প্রবাসীরা সহজ বিনিয়োগ হিসেবে মার্কেট গড়ে তুলছেন।

লন্ডন প্রবাসী হলেও মোতাচ্ছিরুল ইসলাম হবিগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এবং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট। তিনি মনে করেন, সরকার উদ্যোগ নিলে এখনও প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা সম্ভব। সুষ্ঠু পরিবেশ ও বিনিয়োগ ফেরতের নিশ্চয়তা পেলে তারা বিনিয়োগ করবেন। তিনি জানান, স্থানীয় লোকজন কর্তৃক হয়রানি, মিথ্যা মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য বিনিয়োগে প্রবাসীরা আগ্রহী হন না। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে তাদেরকে চাঁদার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হবে না বলে আশ্বস্ত করতে হবে। আর তা না করা হলে ভবিষ্যতে প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের সম্পর্কই থাকবে না। এতে করে তারা আর দেশে রেমিটেন্সই প্রেরণ করবেন না। কারণ এখন সপরিবার ইউরোপ-আমেরিকায় যারা বসবাস করছেন তাদের সন্তানরা দেশের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের যুক্ত করা গেলে পরবর্তী প্রজন্মও দেশে আসবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের (বিইউপি) এক জরিপে দেখা যায় প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় অনুৎপাদনশীল খাতে এবং এর অধিকাংশ ব্যয় হয় ভোগ বিলাসে। জরিপে আরও দেখা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ৬৬.১ শতাংশ অনুৎপাদনশীল খাতে। এর মধ্যে ৫২.৪ শতাংশ আপ্যায়ন, অনুষ্ঠানাদি এবং ৯.২ শতাংশ ঘরবাড়ি ঠিক করার কাজে ব্যয় হয়। বিনিয়োগ খাতের মধ্যে দোকান ও গাড়ি ক্রয় ইত্যাদিতে। ১২.২ শতাংশ ব্যয় হয় অকৃষি খাতে। কৃষি জমি ক্রয় খাতে ব্যয় হয় ১৫ শতাংশ। ০.৮ শতাংশ ভ্রমণ, ৩.৪ শতাংশ ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় হয়।

প্রবাসী পরিবারের যেসব সদস্য দেশে বসবাস করেন তারা বেকার থাকেন। তাদের মধ্যে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়েয়োগের কোনো আগ্রহ নেই। তবে সামান্য একটি অংশ ব্যয় হয় ব্যবসা, পরিবহণ ও অন্যান্য খাতে। এর মধ্যে কৃষি জমি ক্রয়, কৃষিকাজ, কাপড়ের দোকান, ইলেক্ট্রনিক্স দোকান, বেকারি প্রভৃতি। মাত্র ২৯ শতাংশ পরিবার এসব খাতে বিনিয়োগ করছে। ৭৮ শতাংশ পরিবার কোনো বিনিয়োগই করেনি।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের কৃতী সন্তান ও দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, 'প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ না করার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের অনেক ত্রম্নটি-বিচু্যতি এর জন্য দায়ী। আমরা প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগকে যত আকর্ষণীয় করা উচিত ছিল আমরা তা করতে পারিনি। আবার যতটুকু সুযোগ-সুবিধা আছে তাও তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারিনি। একটি সিস্টেমে আমরা বার বার বলি প্রবাসীদেরকে বিনিয়োগের জন্য। কিন্তু কোনো সময় বাস্তবে আমরা তাদের কাছে গিয়ে কৌশলগুলো তুলে ধরতে পারি না। এটি আমাদের বড় দুর্বলতা। সিলেট অঞ্চলে রয়েছে অনেক সম্পদ। বিনিয়োগে অনেক সুযোগ। আমরা এটিকে যদি কাজে না লাগাতে পারি আর প্রবাসীরা আমাদের কাছ থেকে আমাদের ভুলের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাহলে আমাদেরকে আফসোস করতে হবে। কারণ যদি প্রবাসীরা শিকড় বিচ্ছিন্ন করে দেন তাহলে দেশের রেমিটেন্স কমবে। কর্মসংস্থান বাড়বে না।'

তিনি আরও বলেন, এখানে যদি বিদেশি কোম্পানি এসে ব্যবসা করতে পারে তাহলে প্রবাসীরা কেন পারবে না। এ ব্যাপারে কৌশল নির্ধারণ জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84175 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1