বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রপ্তানি আয়ে নতুন খাঁড়া মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থা

নতুনধারা
  ০৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
কর্মরত কয়েকজন গার্মেন্টসকর্মী -সংগৃহীত

বিডি নিউজ

চার মাস পর ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ সামান্য প্রবৃদ্ধির দেখা পেলেও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা ভয় ধরাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মনে।

তারা মনে করছেন, মার্কিন হামলায় ইরানের সামরিক কমান্ডার নিহতের ঘটনায় যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে, তাতে পণ্য রপ্তানিতে নতুন সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর উপর জোর দিচ্ছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) রোববার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আয় গত বছরের একই সময়ের প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। তবে সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে ৩ শতাংশের মতো বেড়েছে।

সুখবর নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেই ধাক্কা খায় রপ্তানি আয়। এরপর টানা চার মাস পতনের ধারাই চলতে থাকে।

আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অক্টোবরে আরও বড় ধাক্কা খায়: এ মাসে কমে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। নভেম্বরে কমে প্রায় ১১ শতাংশ।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাকে দেখছেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে।

তিনি বলেন, 'এমনিতেই আমাদের অবস্থা খারাপ, একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যে যোগ হলো যুদ্ধের দামামা। আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হুমকির মুখে পড়ে গেল।'

আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পেয়ে এলেও এখন সেটাও অনিশ্চয়তায় পড়ল বলে মন্তব্য করেন আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, 'আমেরিকার বাজারে আমাদের রপ্তানি বাড়লেও অন্য দেশগুলো থেকে কিন্তু পিছিয়ে পড়ছি। এতদিন ইউএস মার্কেটে আমরা ৩/৪ নম্বরে ছিলাম। এখন ৭ নম্বরে নেমে এসেছি। এর মধ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ লেগেই যায়, তাহলে নতুন সঙ্কট যোগ হবে।'

ইপিবি'র তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এক হাজার ৯৩০ কোটি ২২ লাখ (১৯.৩০ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ২১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

প্রথম ছয় মাসে গত অর্থ-বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম আয় হয়েছে। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত অর্থ-বছরের প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৫০ কোটি ডলার।

সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ শতাংশ বাড়লেও এই মাসের লক্ষ্যের চেয়ে আয় ছিল ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ কম।

ডিসেম্বরে ৩৫২ কোটি ৫১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৪০৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ৬১ লাখ ডলার।

অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ৯ শতাংশ।

এই ছয় মাসে শাক-সবজি রপ্তানি বেড়েছে ১১৭ শতাংশ। হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি বেড়েছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তামাক রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।

পোশাক রপ্তানি কমেছে ৬.২১%

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৬০২ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ কম।

এই ছয় মাসে নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর উভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।

অর্থ-বছরের প্রথমার্ধে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৮২০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। আর উভেন থেকে এসেছে ৭৮১ কোটি ৮২ লাখ ডলার।

হিসাব করে দেখা গেছে, এই ছয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

আনোয়ার-উল আলম বলেন, 'বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যে যুদ্ধের গর্জন শোনা যাচ্ছে, তাতে আমেরিকায় আমাদের পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ক্রেতারা যে সব দেশের কাছে অথবা লিড টাইম কম- সে সব দেশ থেকে পণ্য কিনবে। কেননা, যুদ্ধ বেঁধে গেলে পণ্য পৌঁছাতে দেরি হবে- এমন ঝুঁকি নেবে না তারা। সে বিবেচনায় আমাদের আমেরিকার অনেক অর্ডার অন্য দেশে চলে যেতে পারে।'

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, 'ভরা মৌসুমের কারণে ডিসেম্বরে কিছুটা ভালো হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে অবস্থা সত্যিই খুবই খারাপ। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে।'

আনোয়ার-উল আলম বলেন, ডিসেম্বরের মতো চলতি জানুয়ারি ও আগামী ফেব্রম্নয়ারিতেও প্রবৃদ্ধি হতে পারে, তবে তারপর প্রবৃদ্ধি আবার কমে যাবে। সে হিসাবে অর্থবছর শেষে কিন্তু নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকবে। আর যদি যুদ্ধ লেগে যায়, সেক্ষেত্রে কিন্তু পরিস্থিতি বেশ খারাপ হবে।'

রুবানা বলেন, 'খুব চিন্তার মধ্যে আছি আমরা। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৬০টি কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে।'

অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান মনসুর বলেন, 'মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে। প্রথমত ইউরোপের দেশগুলো আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সে কারণে সে দেশগুলোর মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। পোশাকসহ অন্যান্য জিনিস কম কিনছে।'

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুরের দেখানো দ্বিতীয় কারণটি অভ্যন্তরীণ।

তিনি বলেন, 'আমাদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেটা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ায়নি বায়াররা। প্রতিযোগী দেশগুলো বাজার ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে; আমরা সেটাও করিনি।'

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের জন্য এখন নগদ সহায়তাসহ সরকারের নীতি সহায়তা চান বিজিএমইএ সভাপতি।

'এই মুহূর্তে আমাদের পলিসি সাপোর্ট দরকার। আমরা রপ্তানি খাতের জন্য টাকা-ডলারের আলাদা বিনিময় রেট চাই। একই সঙ্গে আমরা নগদ সহায়তা ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। খুব দ্রম্নত এসব করতে হবে। মনে রাখতে হবে, খুব কঠিন সময় পার করছি আমরা, আমাদের অর্থনীতি। আরও খারাপ অবস্থা যেন না হয় সেজন্যই সব সিদ্ধান্ত দ্রম্নত নিতে হবে।'

তিনি বলেন, ভারত সরকার তাদের দেশের পণ্য রপ্তানির উপর ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা ৫০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। পাকিস্তান ৭ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে।

এই অবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চীন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো টাকার অবমূল্যায়নের পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে যেটা করতে হবে, সেটা হলো ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমাতে হবে। যে কাজটি আমাদের কমপিটিটর দেশ চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম প্রতিনিয়ত করছে। আমাদেরও এখন সেই কাজটি করতে হবে।'

টাকার অবমূল্যায়নের কথা কিছুদিন ধরে অর্থনীতিবিদরা বললেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত সপ্তাহেও বলেছেন, তেমন কোনো পরিকল্পনা তার নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83453 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1