শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

মহাবিপন্নের তালিকায় 'বনরুই'

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
মহাবিপন্নের তালিকায় 'বনরুই'
বনরুই

বনরুই প্রাণিকুলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। স্বভাবেও অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, লম্বা লেজ গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে। বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরোদেহ ঢেকে বলের মতো করে নেয়। একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এ নিরীহ প্রাণীটি শত্রম্নর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।

সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উঁইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে। এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে। শীতকাল প্রজনন মৌসুম। সাধারণত একটি বা দুইটি বাচ্চা দেয়। বিশ্বে ৮ প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তারমধ্যে বাংলাদেশে মালয়, ভারতীয় ও চায়না বনরুই ছিল। এমন ধারণা থাকলেও বর্তমানে চায়না বনরুই ছাড়া অন্য প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মিলছে না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে বনরুই।

এর ইংরেজি নাম 'চধহমড়ষরহ'। চায়না বনরুইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম 'গধহরং ঢ়বহঃধফধপঃুষধ'। দাঁত নেই বলে আগে দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীর দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার (চযড়ষরফধঃধ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুই। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বনে চায়না প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তবে তা বর্তমানে বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে। মহাবিপন্ন হিসেবে আছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ (আইইউসিএন)। অবাধ শিকার, পাচার, বাসস্থান নষ্টের কারণে এখন তারা মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত।

বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা 'ট্রাফিক'র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য।

'ট্রাফিক'র সূত্রমতে, ২০১০-১৫ সালের মধ্যে বনরুই পাচারে ব্যবহৃত মোট ১৫৯টি 'রুট' পাওয়া গেছে। বনরুইয়ের এক কেজি মাংস ৩৫০-৫০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। চায়না এবং ভিয়েতনামে এর প্রচুর চাহিদা। প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। এশিয়ায় এ প্রজাতি বর্তমানে অতি মহাবিপন্ন।

একসময় চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে নিয়মিত এদের দেখা মিললেও বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বনরুই হারিয়ে গেছে। আদিবাসী গোষ্ঠীদের শিকার এবং পার্বত্য এলাকা থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনে মাংস হিসেবে বনরুই পাচার করার কারণে বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে আর এদের দেখা মেলে না। স্থানীয়দের ভাষায়, এরা এখন বিলুপ্ত।

'প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ' গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বছর পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে ১৯ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা গেলেও কোনো বনরুইয়ের দেখা মেলেনি।

'প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ'র সহকারী গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন জানান, বাংলাদেশে মোট ১১টি সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে বনরুইয়ের ওপর জরিপ করা হয় ২০১৭ সালে। আশার কথা হলো, ১১টি বনাঞ্চলের মধ্যে ৮টিতেই পাওয়া গেছে বনরুইয়ের অস্তিত্ব। আশঙ্কার কথা হলো, এসব বনাঞ্চলে একইসাথে মিলেছে বনরুই শিকারের আলামত। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত বনরুইয়ের মাংস ও আঁশের জন্য এটি শিকার করা হয়ে থাকে।

সবশেষ আইইউসিএন'র লাল তালিকা অনুসারে বিশ্বব্যাপী চায়না বনরুইকে 'মহাবিপন্ন' ও ভারতীয় বনরুইকে 'বিপন্ন' হিসেবে ঘোষণা করেছে। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত 'রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ' উভয় প্রাণীকে বাংলাদেশের জন্য 'মহাবিপন্ন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার শেষ সংকেত।

তাই এখনই সংরক্ষণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রাণীটি যেমন অজানা থেকে যাবে; তেমনি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে সুন্দর আরও একটি বন্যপ্রাণী। ইতোমধ্যে হায়েনা, শোল, নীলগাইসহ অনেক প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এসএম জহির আকন বলেন, 'বনরুই পাচারকারীরা সক্রিয় রয়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবছর ৪টি বনরুই আমরা উদ্ধার করেছি। সেইসাথে বনরুই নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা প্রস্তাব আকারে আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যেসব এলাকায় বনরুই আছে; সেসব এলাকায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে