শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীতিমালা হচ্ছে পাথর উত্তোলনে

মন্ত্রিপরিষদসহ ১৬ দপ্তরের ১৮ সদস্যের কমিটি
নূর মোহাম্মদ
  ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

পাথর উত্তোলনে সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় যে যার মতো পাথর উত্তোলন করছে। এতে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে দেশের কয়েকটি জেলার পরিবেশ ও পর্যটন শিল্প; ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ দূষণসহ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন শিল্প ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পাথর উত্তোলনের নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদসহ সংশ্লিষ্ট ৭টি মন্ত্রণালয়, সংস্থার প্রধান এবং বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় বর্তমানে 'জমি যার খনি তার' এ নীতিতেই চলছে পঞ্চগড়, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাথর উত্তোলন। পরিবেশকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে স্বার্থান্বেষী একটি মহল অধিক মুনাফা লাভের আশায় নির্বিচারে সমতল ভূমি কেটে সাবাড় করে ফেলছে আবাদি জমি। হাজার হাজার একর সমতল ভূমি গভীর গর্তে পরিণত করে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে পরিবেশকে। বোমা মেশিনে পাথর তোলার বিষয়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১০ সালে পাথর উত্তোলনের নীতিমালা তৈরির জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন। পাশাপাশি কোয়ারিগুলোয় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু আজ অবধি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে গত ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পাথর কোয়ারিতে বিদ্যমান সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৭টি মন্ত্রণালয়, ৪ বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় পরিবেশ রক্ষায় দ্রম্নত সময়ের মধ্যে অবৈজ্ঞানিক পন্থায় পাথর উত্তোলন বন্ধের জন্য মতামত আসে। একই সঙ্গে পাথর উত্তোলনে সরকারের নীতিমালার না থাকার বিষয়টি আলোচনা হয়। পরে পাথর উত্তোলনের সমস্যা নিরসনের জন্য একটি নীতিমালা করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) শেখ মজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং মন্ত্রিপরিষদ

বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসনের যুগ্মসচিব মুশফিকুর রহমানকে সদস্যসচিব করে ১৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ে একটি কমিটি করা হয়। কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন ও জেলা ও মাঠ প্রশাসন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ বিভাগ, ভূমি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু, শিল্প, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বা যুগ্মসচিব পদ মর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা, রংপুর, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন বু্যরো, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আছেন এ কমিটিতে। কমিটি পাথর উত্তোলনে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব এবং বন্ধে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে পাথরে চাহিদা ও যোগান বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সুপারিশ করবে। কমিটি প্রয়োজনে পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করতে পারবে। একই সঙ্গে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ও তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কমিটির আগামী তিন মাসের মধ্যে সুপারিশসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পেশ করবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভা সূত্রে জানা গেছে, দেশে গ্রেজেটভুক্ত মোট ৫০টি পাথর কোয়ারি রয়েছে। এসকল কোয়ারি থেকে দেশের চাহিদার মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পাথর উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে। এ সামান্য পাথর তুলতে গিয়ে কোয়ারি সংশ্লিষ্ট এলাকার নদীভাঙন, ভূমিধস, পরিবেশদূষণসহ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন শিল্পের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। নিয়মিত মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত অর্থবছরে এই সেক্টর থেকে মাত্র ১৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও পর্যটন খাত। এ জন্য পরিবেশদূষণ রোধ ও দেশের পর্যটন শিল্পকে রক্ষা করতে পাথর উত্তোলন বন্ধের মতামত দেন সংশ্লিষ্টরা।

সভায় রংপুর বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পঞ্চগড় জেলায় ১৯টি পাথর কোয়ারি থেকে গত বছর মাত্র ৭৮ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ পাথর তুলতে গিয়ে ফসলি জমি ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সময় তিনি জানান, লালমনিরহাটে ৩টি কোয়ারি গত তিন বছর ধরে ইজারা হয় না। এসব বাস্তবতায় পাথর উত্তোলন বন্ধের সুপারিশ করেন তিনি। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পাথর উত্তোলন এক বছর বন্ধ রাখলে এ অঞ্চলের চেহারা বদলে যাবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধ করা হলে বালকি শ্রমিকদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। তারা পর্যটনসহ অন্যান্য পেশায় যুক্ত হতে পারবে। ইজারা ও রয়েলিটি আদায় থেকে যে আয় হয় এর চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ২০১৯ সালে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী পাথর উত্তোলন বন্ধের পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দিলে বালকি শ্রমিকদের সমস্যা হতে পারে। কেবল নির্ধারিত জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করা যেতে পারে। এতে ভূমি মন্ত্রণালয় এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সার্ভে ম্যাপ ও চৌহদ্দি ঠিক করে দিতে পারে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বলেন, দেশে উৎপাদিত পাথর মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ চাহিদা মেটায়। পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ করে বিদেশ থেকে আমদানি করলে দেশের মানুষ ও পরিবেশের বেশি লাভ হবে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হলে প্রয়োজনীয় অনুশাসন পাওয়া যাবে।

খনিজ সম্পদ উন্নয়ন বু্যরোর মহাপরিচালক বলেন, পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পন্থা স্থির করা যেতে পারে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, পাথর উত্তোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়ে সকল স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক বলেন, পাথর উত্তোলনের জন্য খুব কম জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। বাকি সকল জায়গা বন্ধ করা উচিত। আগামী ২০ বছর কী পরিমাণ পাথর লাগতে পারে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাথর সাইজ বলে দিলে সে অনুযায়ী পাথর আমদানি করা যায়। এতে ক্রাশার জোন স্থাপন ও পরিবেশদূষণের বিষয় থাকবে না। সভায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রতিনিধি জানান, ১০ মেট্রিক টনের বেশি ওজন পরিবহণ করা হলে এলজিইডির রাস্তা ভেঙে যেতে পারে। পাথর উত্তোলন একসঙ্গে বন্ধ করে দিলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পর্যায়ক্রমে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার) শেখ মুজিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, পাথর উত্তোলন নিয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাথর উত্তোলনের বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা দ্রম্নত সময়ে একটি সভা ডাকব। দ্রম্নত সময়ের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে পারব।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, হাইকোর্ট নির্দেশনা দেয়ার ১০ বছর পর সরকারের বোধগম্য হলো পাথর উত্তোলনে একটা নীতিমালার প্রয়োজন। তিনি বলেন, দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে না পারলে সিলেট, পঞ্চগড়ের পরিবেশ বলতে কিছু থাকবে না। তিনি দ্রম্নত সময়ের নীতিমালা করার দাবি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79995 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1