২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি দিনটির কথা হয়তো অনেকের মনে থাকবে। ঢাকার পুরনো অংশে বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে শেষ হওয়া 'জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট' দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হবে।
দন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হতে পারে, সেই প্রস্তুতি নিয়েই হয়তো গুলশানের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
থমকে থাকা ঢাকার জনশূন্য রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিশেষ আদালতে সেদিন বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহর পৌঁছতে লেগে গিয়েছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা।
নানা নাটকীয়তা আর সহিংসতায় পূর্ণ সেই যাত্রা বাংলাদেশের বহু মানুষ সেদিন টানটান উত্তেজনা নিয়ে অবলোকন করেছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়।
এর প্রায় ১৮ মাস পর বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আবেদনটি খারিজ করে দেয়।
খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন খারিজ হলো যে মামলাটিকে ঘিরে, সেটি খালেদা জিয়ার নামে থাকা আরেকটি আলোচিত মামলা, 'জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট' নামের প্রতিষ্ঠানে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ।
এই মামলাটি এবং আরও যেসব মামলায় খালেদা জিয়ার যে সাজা হয়েছে বা বিচার চলছে, জেনে আসা যাক সেগুলো সম্পর্কে :
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা
২০০৮ সালে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এই মামলাতেই সাজা পেয়ে প্রথমবারের মতো দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয় খালেদা জিয়াকে। এর আগে তাকে অন্তরীণ হতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে।
গত বছরের ৮ ফেব্রম্নয়ারি পুরান ঢাকার বিশেষ আদালতের বিচারক তার রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন এবং ওইদিনই কারাগারে যেতে হয় তাকে। সেই থেকে এখনো কারাবন্দি রয়েছেন তিনি।
মামলার অভিযোগ ছিল, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দেওয়া হলেও তা এতিম বা ট্রাস্টের কাজে ব্যয় করা হয়নি। বরং সেই টাকা নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
রায়ে খালেদা জিয়ার একমাত্র জীবিত সন্তান তারেক রহমান, যিনি এখন ব্রিটেনে বসবাস করছেন এবং সেখানে বসেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বও পালন করছেন, তাকেও ১০ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়।
মামলাটির তদন্ত শেষ হলে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে; কিন্তু আদালতে অভিযোগ গঠন হয় ২০১৪ সালের মার্চ মাসে।
বকশীবাজারের বিশেষ জজ আদালতে এ মামলার বিচার কার্যক্রম চলে। এর মধ্যে ৩২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং ১৬ দিন ধরে যুক্তিতর্ক চলেছে।
আদালতে হাজির না হওয়ায় কয়েকবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছিল।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর এ মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয় বিশেষ আদালতে।
সেখানে খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
মূল অভিযোগ- প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই ট্রাস্টের জন্য ছয় কোটি ১৯ লাখ টাকার তহবিল জোগাড় করেছিলেন।
নাইকো মামলা
কানাডার জ্বালানি কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি করে রাষ্ট্রের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি করায় এই মামলাটিও হয় ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়।
মামলায় শেখ হাসিনাকেও আসামি করা হয়েছিল, কারণ এ চুক্তিটি প্রথম করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
পরে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আদালত শেখ হাসিনাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়।
তবে মামলাটি রয়ে যায় এবং আসামি হিসেবে থেকে যান খালেদা জিয়া।
গ্যাটকো মামলা
ঢাকার কমলাপুরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে গ্যাটকো নামে একটি কোম্পানিকে দেওয়ার অভিযোগে এ মামলাটিও হয় ২০০৭ সাল পরবর্তী সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে দায়ের করা এ মামলার অভিযোগ ছিল- চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি শর্ত ভেঙে সরকারের চোখের সামনে অতিরিক্ত এলাকায় কয়লা খনন করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে এবং খালেদা জিয়া রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।
দুর্নীতির এ পাঁচটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা নাশকতার। সেই সঙ্গে রয়েছে মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের কিছু মামলা।
১৫ আগস্ট তার জন্মদিনটি ভুয়া- এ অভিযোগেও একটি মামলা রয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে।
বিএনপি সবসময় অভিযোগ করে, এইসব দুর্নীতির মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ বরাবরই নাকচ করা হয়েছে।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৭-০৮ সালে তাদের বিরুদ্ধে করা এ রকম শত শত মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করে নিলেও বিএনপির করা আবেদনগুলো বিবেচনা করেনি।