শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতিবাজ গডফাদাররা আতঙ্কে

সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ায় বিভিন্ন মহলে স্বস্তি ও উচ্ছ্বাস ষড়যন্ত্রের ধোঁয়া তুলে পানি ঘোলা করার পাঁয়তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে ভোল পাল্টে গা-ঢাকা দিচ্ছে ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা
সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

'ক্যাসিনো কিং' খ্যাত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (সদ্য বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট রোববার ভোরের্ যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ায় বিভিন্ন মহলে স্বস্তি ফিরলেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যদের মধ্যে নয়া আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এছাড়া যেসব দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গডফাদারের সঙ্গে সম্রাটের অবৈধ লেনদেনের পাশাপাশি নানা ধরনের যোগাযোগ ছিল তারা এখন চরম উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। অনেকে ভিন্ন নামে চেক ইসু্য করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে তা অন্যত্র সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

অন্যদিকে সম্রাট কানেকশনে নানা অবৈধ অপতৎপরতা চালিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। শুদ্ধি অভিযান শুরুর দুই সপ্তাহ পরও সম্রাটকে গ্রেপ্তার না করায় তারা এতদিন যে উদ্ধত দেখাচ্ছিল তা পুরোপুরিই থেমে গেছে। বেপরোয়া এসব সহযোগী এখন দ্রম্নত ভোল পাল্টে গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদের কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমানোরও ফন্দি আটছেন।

গোয়েন্দারা জানান, মাদক পাচারকারী ও ক্যাসিনো হোতাদের পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনদের সঙ্গে সম্রাটের গভীর যোগাযোগ থাকার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হলেও তাদের কার সঙ্গে কোন ধরনের লেনদেন ছিল এবং এই হোতাদের আসল পরিচয় কী, তা এখনো অনেকের অজানা। এছাড়া এদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচ্ছিন্ন তথ্য থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ ছিল না। তাই তাদের বিরুদ্ধে এতদিন আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভুইয়া গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যেভাবে দুর্নীতিবাজ চক্রের বেশ ক'জন হোতাকে চিহ্নিত করা গেছে, তেমনি সম্রাটের দেওয়া তথ্যেও অনেক মুখোশধারীর স্বরূপ উন্মোচিত হবে- এমনটা আশা করছেন গোয়েন্দারা। আর এ আশঙ্কাতেই দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী গডফাদাররা তটস্থ হয়ে উঠেছেন।

সম্রাটের ক্যাসিনো-কান্ড ও চাঁদাবাজিসহ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অনুসন্ধানের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর কাকরাইলের কার্যালয় থেকে সম্রাট আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়ার পর তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারিতে নেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের নামে-বেনামে কোথায় কত অর্থ-সম্পদ রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জুয়া-ক্যাসিনো পরিচালনা ও ইয়াবা বাণিজ্যে সম্পৃক্ত অন্তত এক ডজন গডফাদারকে চিহ্নিত করা হয়েছে; সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের বিপুল অর্থ-বিত্তেরও। এদের অনেকে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর দ্রম্নত নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অংকের অর্থ তুলে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেছেন। এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মাত্র কয়েক বছরে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট তার সহযোগীদের নিয়ে 'ক্যাসিনো কিং' হয়ে উঠলেও তাকে মূলত আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন রাজনৈতিক গডফাদাররা। এমনকি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন একাধিক ব্যক্তিও তার মদদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। যাদের সম্রাট নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারা দিতেন। অথচ এসব হোতা এখনো ধরাছোঁয়ার পুরোপুরি বাইরে রয়েছে। যদিও খোদ প্রধানমন্ত্রীই এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগাম গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে রেখেছেন। তবে এরপরও তা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে- যোগ করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রাথমিকভাবে যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে সম্রাটকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলেও বিভিন্ন পর্যায়ের অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম উঠে এসেছে। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখনো গোয়েন্দাদের হাতে আসেনি। অথচ এ ধরনের রাঘববোয়ালদের পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ১

বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অ্যাকশনে নামার আগে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ অত্যন্ত জরুরি। তাই সম্রাটকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, সম্রাটের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আগে সর্বোচ্চ আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার জন্য গোয়েন্দারা আগাম তাগিদ দিয়েছেন। কেননা এসব রাজনৈতিক হোতা এ ইসু্যতে 'পানি ঘোলা' করতে পারে, এ ধরনের আভাস তারা আগেভাগেই পেয়েছেন। যা তারা ইতিমধ্যেই সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে অবহিত করেছেন।

ওই কর্মকর্তার দাবি, সম্রাটের উত্থান এবং তার রাজনৈতিক জীবনের গতিধারা বিশ্লেষণ করে তিনি কার কাছ থেকে কী ধরনের সুবিধা নিয়েছেন, কাকে কীভাবে সুবিধা দিয়েছেন তা কিছুটা হলেও জানা যাবে। আর এর সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালালে নিশ্চয়ই 'থলের কালো বিড়াল' বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে সম্রাটের মোবাইল ফোনের সিডিআর (কল ডিটেইলস রেকর্ড) ঘেঁটে তার গডফাদারদের সম্পর্কে বেশকিছু প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও দাবি করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই কর্মকর্তা। 

এদিকে সম্রাট গ্রেপ্তারের পর তার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা অনেকে তটস্থ থাকলেও গডফাদারদের কেউ কেউ ভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দারা সরকারকে সতর্ক করেছেন। তারা জানিয়েছেন, শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে একটি চক্র বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্রের ধোঁয়া তুলে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যার সুর খোদ সম্রাটের কণ্ঠেও শোনা গেছে।

গত রোববার তলস্নাশি অভিযান শেষে সম্রাটকে তার কাকরাইলের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি এ ঘটনাকে সাজানো নাটক ও গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করেছেন। এ সময় সম্রাটের ব্যক্তিগত ক্যাডাররা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরও পাঁয়তারা চালিয়েছে।

যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার ভোরে সম্রাট গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনার কথা বলে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল বের করার জন্য যুবলীগের কর্মীদের চাপ দেন। তবে তারা সংঘবদ্ধ হতে না হতেই সম্রাটকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা আসায় কর্মীরা অনেকেই সরে পড়েন। এতে বিক্ষোভ মিছিলের উদ্যোগ পুরোপুরি ভেস্তে যায়।

ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক নেতা যায়যায়দিনকে জানান, রোববার দুপুরে সম্রাটকে তার কাকরাইলের অফিসে নিয়ে যাওয়ার পরও তাদের সংঘবদ্ধ হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য একাধিক মহল থেকে উসকানি দেওয়া হয়। তবে সম্রাটকে গ্রেপ্তারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকায় তারা সে ফাঁদে পা দেয়নি।

ওই নেতাদের দাবি, যুবলীগের নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীরা সম্রাট-খালেদ কিংবা তাদের গডফাদারদের কারও কাছ থেকে কোনো অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেননি। বরং সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অরাজনৈতিক ক্যাডাররাই সব সময় তাদের ঘিরে রেখেছে। তারাই তাদের কাছ থেকে নানা অনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে। এ কারণেই সম্রাট-খালেদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, মদ-জুয়া-ক্যাসিনো পরিচালনা এবং চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ফাঁস হওয়ার পরও তারা এ নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে। এসব ক্যাডারের নেপথ্যে সম্রাট-খালেদের চেয়েও বড় গডফাদারদের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে সম্রাটের একাধিক গডফাদার ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের রাজনীতির মাঠে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিষয়ে গোয়েন্দারাও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। এ বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। পাশাপাশি সম্রাটকে গ্রেপ্তার ও তাকে দল থেকে বহিষ্কারসহ এ সংক্রান্ত কোনো ইসু্যতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্রাটের বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়ে ওই মামলা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তার গডফাদারদের সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। পরে তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো পরিচালনা এবং এ উৎস থেকে উপার্জিত বিপুল অংকের অর্থ বিদেশে পাচার সংক্রান্ত আরও দুটি মামলা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70461 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1