বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাঁটতে পারার আনন্দে কাঁদছে শাহনূর

জাহিদ হাসান
  ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:৩৩
শাহানূর বিশ্বাস

দীর্ঘ চার বছর পর কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে হাঁটতে পারার আনন্দে স্ত্রী ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছিলেন শাহানূর বিশ্বাস (৫৫)। বাবার চোখে এই আনন্দ অশ্রম্ন দেখে ছলছল নয়নে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলেন ২৫ বছর বয়সি মেয়েও। কৌতূহলী দৃষ্টিতে পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে বাবা-মেয়ের এই কান্না দেখছিলেন অনেকেই। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে শাহানূর বিশ্বাস জানান, দীর্ঘ চার বছর পর ফের নিজের পায়ে হাঁটতে পারায় তাদের চোখে এ আনন্দাশ্রম্ন। শাহানুরের মেয়ে শারমিন আক্তার জানান, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ আর স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত তারা দুই বোন। এ সময় মাহাবুব মেম্বারের ছেলে আজম ও তার সঙ্গী বিলস্নাল, দুখু, জাহিদ, মোতালেব, ওয়ার্ড মেম্বার কামাল ও জাহিদ তাদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর এ ঘটনার বিচার চাইতে গেলে তারা শাবল দিয়ে কুপিয়ে বাবাকে আহত করে। মেম্বার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এ ঘটনা ঘটায়। প্রথমে ডান পায়ে গুলি করে। পরে শাবল দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি থেকে মাংস তুলে নেয়। এরপর ২ মাস জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) কাটানোর পর বাড়ি ফিরলেও দুই মেয়ে আর এক পুত্রসহ পাঁচজনের পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম তারা বাবা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর ৩ বছর কেটে গেছে। গত কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে ফোন করে তাকে নতুন স্বপ্ন দেখায় নিটোর চিকিৎসকরা। তারা জানায়, কৃত্রিম পা সংযোজন করা হবে। আশা নিয়ে এসে স্বপ্ন সত্যি হলো। নিটোরে কল্যাণে এখন দু পায়ে দাঁড়িয়ে হেঁটে তার বাবা বাড়ি যাচ্ছেন। এ ছাড়া নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী বিদু্যৎ দে (২৫) বলেন, বছর তিনেক আগে বাস দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি। এঙ্েিডন্টের পর এখানে (পঙ্গু) চিকিৎসা নিতে এসে বিনামূল্যে কৃত্রিম পা দেওয়ার কথা শুনে নাম রেজিস্ট্রেশন করেন। কৃত্রিম পা সংযজোনের পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফরিদপুরের জজ মিয়া (৬০) বলেন, পা হারিয়ে আবার হাঁটতে পারব ভাবিনি। কিন্তু এখানে নাম লেখানোর পর থেকে মনের মধ্যে আশা জিইয়ে রাখছিলাম। আজ তা পূর্ণ হলো। গত বুধবার দুপুরে পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে কৃত্রিম অঙ্গ কেন্দ্র বা লিম্ব সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে বিদেশি ব্যক্তিরা (ভারতীয় আর্টিফিসিয়াল লিম্ব ওয়ার্কার) গভীর মনোযোগ দিয়ে কৃত্রিম পা তৈরি করছেন। পাশেই নতুন পা লাগানোর আশায় স্বজনদের সঙ্গে অন্তত বিশ-পঁচিশজন পা হারানো ব্যক্তি বসে অপেক্ষা করছেন। পঙ্গু হাসপাতালের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে ভারতের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান শ্রী ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতির সুপারভাইজর (তত্ত্বাবধায়ক) রঞ্জন নসুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ভারতের জয়পুর ফুট অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ অর্থপেডিকস সোসাইটি ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ এটি। এখানে ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশের গরিব রোগীদেরকে বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় এ বছরও ভারতীয় হাইকমিশনের আয়োজনে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ অর্থোপেডিকস সোসাইটি এই উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ২৮ সেপ্টম্বর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। লিম্ব সেন্টারের সাবেক ইনচার্জ মোজহার হোসেন মোলস্না যায়যায়দিনকে বলেন, এখানে জয়পুর ফুট অর্গানাইজেশনের কৃত্রিম পা সংযোজন কার্যক্রমের টিম লিডার প্রকাশ ভান্ডারীর তত্ত্বাবধানে ৮ জন দক্ষ ভারতীয় টেকনেশিয়ান প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ জনের কৃত্রিম পা সংযোজন করছেন। ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে তারা প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০টি কৃত্রিম পা তৈরি করবেন। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা যাদের কৃত্রিম পায়ের প্রয়োজন তাদেরকে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে বহির্বিভাগের দুটি কক্ষে সারাবছর নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহফুজুল হক তালুকদার যায়যায়দিনকে বলেন, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আকস্মিক পা হারানো গরিব মানুষের জন্য ভারতের জয়পুর ফুট অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ অর্থোপেডিকস সোসাইটির একটি চলমান প্রকল্প এটি। এ ছাড়া ভারতের মঈন ফাউন্ডেশনও এ কার্যক্রমে সহায়তা করছেন। প্রতি বছর এখানে প্রায় এক হাজার দুইশ মানুষের কৃত্রিম পা সংযোজন করা হচ্ছে। চলতি প্রকল্পের এই মেয়াদে ৫০০ জনকে সেবা দেওয়া হবে। মূলত, মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় অর্র্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভারতীয় হাইকমিশন, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি ও শ্রী ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতির সহযোগিতায় আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৫ শতাধিক পাহারা মানুষকে বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হবে। মঈন ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আরও ৭০০ ব্যক্তি বিনামূল্যে এ সেবা পাবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে