শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খোলাবাজারে টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি

৯টায় শুরু, ১১টাতেই শেষ
নতুনধারা
  ০২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ০২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০৩
মঙ্গলবার রাজধানীতে খোলা বাজারে ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করে টিসিবি। ছবিটি জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

যাযাদি রিপোর্ট আকাশচুম্বী দাম নিয়ন্ত্রণে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ঢাকা মহানগরীর ৩৫টি স্পটে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বেশিরভাগ ক্রেতা পেঁয়াজ কিনতে না পারায় এ নিয়ে জনভোগান্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে হতাশাও। বিষয়টি স্বীকার করে ডিলাররা জানান, টিসিবি থেকে খুবই সামান্য পরিমাণ পেঁয়াজ সরবরাহ করায় তারা ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। সকাল ৯টায় খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরুর পর দুই ঘণ্টা পার হতে না হতেই তা ফুরিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এর চেয়েও কম সময় লেগেছে। তাই বিপুলসংখ্যক ক্রেতাকে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। ন্যায্যমূল্যে বিক্রির জন্য ডিলারদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজ সরবরাহ করা না গেলে এর কোনো প্রভাব বাজারে পড়বে না, এটাই স্বাভাবিক- যোগ করেন তারা। এদিকে টিসিবির এ ধরনের কার্যক্রম লোক দেখানো এবং রীতিমতো হয়রানিমূলক বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের ভাষ্য, দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের মজুদ থাকার দাবি করে টিসিবিকে দিয়ে সামান্য পরিমাণ পেঁয়াজ বিক্রি করানো ঘটনা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এ ঘটনায় পেঁয়াজের বাজারে উল্টো নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ক্রেতারা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর অন্তত ৭টি পেঁয়াজ বিক্রির স্পট ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও লাইনে দাঁড়ানো ক্রেতার সিকিভাগও ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ কিনতে পারেননি। সকাল ১১টার পর টিসিবির সব ডিলারই পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেন। যদিও খোলা ট্রাকে চাল, আটা ও তেলসহ অন্যান্য পণ্য যথারীতি বিক্রি হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মালিবাগে টিসিবির খোলা ট্রাকের পেছনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই পেঁয়াজের ক্রেতা। অথচ এ সময় ট্রাকে মাত্র আধা বস্তা পেঁয়াজ মজুদ ছিল। ওই ট্রাকের সেলসম্যান ফরিদ জানান, তারা অন্তত সাড়ে ৪০০ ক্রেতার কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। এদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন ১ কজি করে পেঁয়াজ নিলেও বাকিরা সবাই ২ কেজি করে পেঁয়াজ কিনেছেন। একই পরিবারের একাধিক সদস্য পেঁয়াজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছে বলে জানান এই সেলসম্যান। অন্যদিকে লাইনে দাঁড়ানো একাধিক ক্রেতার অভিযোগ, বেশকিছু দোকানি ডিলারের সেলসম্যানদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ২০-২৫ কেজি করে পেঁয়াজ নিয়ে গেছে। এ কারণে অল্প সময়ের মধ্যে তা ফুরিয়ে গেছে। যদিও ডিলাররা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। খিলগাঁও বৌবাজার মোড়ে রাখা টিসিবি পণ্যের ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনতে সকাল সাড়ে ১০টার সময় লাইনে দাঁড়িয়েছেন মোটর মেকানিক সেলিম মিয়া। তিনি জানান, তার আগে ৭০-৮০ জনের কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছে। এর পর আর কাউকে পেঁয়াজ দেওয়া হবে না বলে সেলসম্যানরা তাদের জানিয়ে দেন। অথচ কিছু সময় পর একজন ক্রেতার কাছে ১০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। এ সময় অন্যরা এর কারণ জানতে চাইলে, ওই ক্রেতা ডিলারের আত্মীয় বলে দাবি করেন সেলসম্যান। যদিও সংশ্লিষ্ট ডিলার তা অস্বীকার করেছেন। গোড়ানের গৃহবধূ শামীমা খাতুন জানান, তিনি সন্তানকে স্কুলে দিয়ে সকাল সোয়া ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সোয়া ১১টার দিকে তাকে এক কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজের দাম কম হলেও এর মান বেশ খারাপ বলে জানান শামীমা। তার এ অভিযোগ যে অসত্য নয়, তা তার ব্যাগে থাকা পেঁয়াজ দেখে অনুমান করা গেছে। দেখা গেছে, এক কেজি পেঁয়াজের মধ্যে অন্তত পাঁচটি পেঁয়াজ নীল বর্ণের এবং এক পাশ কিছুটা পচা। সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে টিসিবির পণ্য বিক্রি ট্রাকের কাছে গিয়ে প্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সেখানে লাইনে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও ওইসময় ট্রাকে ২০ থেকে ৩০ কেজি পেঁয়াজ ছিল। সেলসম্যানদের দাবি, অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় সবসময়ই মতিঝিলে ক্রেতার আধিক্য থাকে। এ কারণে সেখানে আগেভাগেই সব পেঁয়াজ বিক্রি হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্পটে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমে পাঁচটি স্পটে এ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা থাকায় সোমবার থেকে তা বাড়িয়ে ৩৫টি স্পট করা হয়েছে। একজন ডিলার কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা দরে প্রতিদিন এক হাজার কেজি (১ টন) পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এর পরিমাণ আরো বাড়ানো হলে ভালো হতো। যদিও তা এখন সম্ভব হচ্ছে না- যোগ করেন টিসিবির এই কর্মকর্তা। টিসিবির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে মিসর ও তুরস্ক থেকে আমদানি করা দুই জাহাজ পেঁয়াজ ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যেই এ পেঁয়াজ বাজারে আসবে। তখন দাম কমবে। পাইকারি কিংবা খুচরা বিক্রেতারা তখনও সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ বিক্রির অপচেষ্টা চালালে তখন টিসিবি আরো বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে। দুপুর ১২টার দিকে রামপুরায় টিসিবির ট্রাকের কাছে গিয়ে দেখা গেছে, সেলসম্যানের সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবকের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে ট্রাক সেল শুরু করার কথা থাকলেও ১০টার পর কেন সেখানে ট্রাক এসেছে এবং সাড়ে ১১টার মধ্যে কেন পেঁয়াজের মজুদ ফুরিয়েছে- উত্তেজিত যুবকরা তা সেলসম্যানের কাছে জানতে চাইছেন। ওই যুবকদের অভিযোগ, ডিলার অন্য কোথাও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়ে অল্প কিছু পেঁয়াজ নিয়ে সেখানে এসেছে। এ কারণে তাদের আসতে বিলম্ব হয়েছে। সেখানে দুইশ' থেকে আড়াইশ' জনের বেশি ক্রেতার কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন তারা। বনশ্রীতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহিণী জরিনা বিবি জানান, তিনি ১০টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তার সামনে আরো ৫০-৬০ জন মানুষ আছে। সেলসম্যানরা খুব ধীরে মাল বিক্রি করছে। আর কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনতে পারবেন কিনা তা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন তিনি। সেখানকার টিসিবির ট্রাক থেকে দুই কেজি পেঁয়াজ কিনে হাসিমুখে ঘরে ফিরছিল স্কুল শিক্ষার্থী দিদার আলী। পরনে আইডিয়াল স্কুলের ইউনিফর্ম থাকা এই কিশোর জানায়, বাবার সঙ্গে সেখানে এসেছিল টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ কিনতে। তবে অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় বাবা তাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে কর্মস্থলে ছুটে গেছেন। তবে পেঁয়াজ কিনতে দেরি হওয়ায় তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এদিকে টিসিবির পণ্য বিক্রির দায়িত্বে থাকা একাধিক সেলসম্যান জানান, গত কয়েকদিন ধরে এক হাজার কেজি করে পেঁয়াজ দেওয়া হলেও সোমবার থেকে ডিলারদের কাউকে ৬শ' আবার কাউকে ৫শ' কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এর চেয়েও কম পেয়েছেন। আগের চেয়ে বেশি স্পট বাড়িয়ে একই পরিমাণ পেঁয়াজ সবখানে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে অনুমান করেন তারা। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, সৈনিক ক্লাব, জুরাইন পোস্তাগোলা, মিরপুর ৬০ ফিট, আনসার ক্যাম্প, মোহাম্মদপুর, বছিলা, নিউ মার্কেট, ছাপড়া মসজিদ, আজমপুর, উত্তরা, মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, দিলকুশা বক চত্বর, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার বদ্ধভূমি, মিরপুর-১০ ও কচুক্ষেত এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ৩৫টি ট্রাকে টিসিবি ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে