শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্ক্রিনিং-ম্যাচিং ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ সরকারি হাসপাতালে

জাহিদ হাসান
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
রক্তদাতার শরীর থেকে রক্ত নেয়া হচ্ছে -ফাইল ছবি

অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের রক্তদানকেন্দ্রগুলোতে রক্তদাতার শরীর থেকে রক্ত নেয়ার পর তা স্ক্রিনিং ও ক্রস-ম্যাচিং করা হয়। ফলে দাতার রক্তে পরে কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তা ফেলে দিতে হচ্ছে। এতে নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ আগে দাতার রক্তের স্যাম্পল সংগ্রহ করে ক্রসম্যাচিংসহ ৫ ধরনের পরীক্ষা করা হলে অনায়াসেই এ সংকট কাটনো সম্ভব।

রাজধানীর অন্তত ১০টি সরকারি হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালনকেন্দ্র (বস্নাড ব্যাংক) ঘুরে সেখানে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের অভিযোগ, রক্তদানের আগে অবশ্যই দাতা ও রোগীর বস্নাড স্যাম্পল (সামান্য রক্ত উপাদান) সংগ্রহ করে স্ক্রিনি বা ক্রসম্যাচিং করে নিলে ভালো হয়। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে প্রায় ৯০ ভাগ সরকারি হাসপাতালের বস্নাড ব্যাংকে দাতার শরীর থেকে ৫টি মেজর টেস্ট (হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি) করার আগেই ফুল ব্যাগ রক্ত নিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে রোগী ও দাতাদের অজ্ঞাতসারে নামমাত্র পরীক্ষা করে রোগীর দেহে পুশ করা হয়। এতে করে সঠিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে রোগী, রক্তদাতা উভয়ই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও মানসিক অবসাদ ভোগেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ থাকতে মানুষের মৌলিক চাহিদার মতো চিকিৎসার স্বার্থে নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের দরকার পড়ে। এজন্য ২০০৮ সালে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রক্ত দেয়া ও নেয়ার জন্য নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন বিধিমালা করা হয়েছে। বিধিমালায় বলা আছে, সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে রক্ত আদান-প্রদানের আগে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা লাগবে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এই বিধিমালার অনেক কিছুই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এতে আতঙ্কিত হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় বস্নাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ। গত সোমবার সরেজমিন মেডিকেলের বস্নাড ব্যাংকে

সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, রক্তের ক্রসম্যাচিং ছাড়াই ডোনারের রক্ত নিচ্ছেন কর্তব্যরত কর্মীরা। এ বিষয়ে কিছু ডোনার খুশি হলেও অধিকাংশ ডোনার ও রোগীর স্বজন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি বন্ধুর স্ত্রীকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে সুমন নামের এক যুবক রক্ত দিতে এসেছিলেন। ক্রসম্যাচিং ছাড়া রক্ত দেয়া নিয়ে বিব্রত হয়ে তিনি বলেন, 'বিষয়টা দেখে অবাক হচ্ছি। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফরম পূরণ শেষে রক্ত নেয়া শুরু করে দিল। এটা তো কোন সিস্টেম হতে পারে না। জিজ্ঞেস করার পরে তারা বলেছেন রক্ত নিয়ে পরে ক্রসম্যাচিং করে নেবেন, এ কথার ওপর কতটা আস্থা রাখা যায় বলেন? এখন আমার রক্তে কোনো সমস্যা থাকলে সেই রক্ত রোগীকে দেয়া কতটা নিরাপদ হবে।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বস্নাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাশফিয়া ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, রক্ত নিতে হলে বস্নাড ক্রসম্যাসিং করা আবশ্যক। বিধিমালা মোতাবেক রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হলে অবশ্যই ক্রসম্যাচিং দরকার। কারণ ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন গড়ে ২৩০ থেকে ২৫০ ব্যাগ পর্যন্ত রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। কোনো রক্ত ক্রসম্যাচিং ছাড়া রোগীকে সরবরাহ তারা করেন না। তবে ডোনারদের চাপ থাকায় অনেক সময় ক্রসম্যাচিং ছাড়া রক্ত নিলেও ক্রসম্যাচিং ছাড়া রোগীদের দেন না।

এছাড়া গত মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে একজন মুর্মূষু রোগীর অস্ত্রোপচারের জন্য স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে যান মোহাম্মাদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের শিক্ষার্থী তানভির ইসলাম। তিনি অভিযোগ করেন বস্নাড ব্যাংকে যাওয়ার পর রোগীর রক্ত উপাদানের সঙ্গে তার রক্তের কোনো ধরনের স্ক্রিনিং বা ক্রসম্যাচিং করার পূর্বেই শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে নেয়া হয়। অথচ রক্তদানের পূর্বে তার রক্ত রোগীর জন্য নিরাপদ কিনা সেটা জানার সুযোগ হয়নি। অথচ আগে দু'জনের রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ক্রসম্যাচিং করে নিলে কোনো সমস্যা হতো না।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে রক্ত দিতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিকিৎসকদের কাছেই শুনেছেন 'এভরি বস্নাড ডোনার ইজ এ হিরো অর্থাৎ প্রত্যেক স্বেচ্ছায় রক্তদাতা এক একজন বীর।' এ জন্য এই প্রথমবার একজন অসহায় রোগীকে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে যান। কিন্তু এর কিছুদিন পর একটা বেসরকারি হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করে তার হেপাটাইটিস বি ভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ে। তিনি আফসোস করে বলেন, তার রক্ত রোগীকে দেয়া হয়েছে কিনা সেটা জানতে পারেন নি। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগেই স্ক্রিনিং ও ক্রসম্যাচিং করে নিলে তাকেও রক্ত দিতে হতো না আর রোগীও বি-ভাইরাস ঝুঁকিতে পড়ত না।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুদা বেগম যায়যায়দিনকে বলেন, বিএসএমএমইউতে এমনটা হয় না। এতে বস্নাড নষ্ট হয়। আবার অনেক হাসপাতালে নজরদারির অভাবে কালো বাজারির আশঙ্কা থাকে। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেরে মতো বিএসএমএমইউতে ১২ থেকে ১৩ ধরনের ডোনার ক্রাইটেরিয়ার মিল থাকা সাপেক্ষে রক্ত নেয়া হয়। তারপর দাতা ও গ্রহীতার স্যাম্পলের ক্রসম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজ করা হয়।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের 'সেফ বস্নাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম প্রজেক্ট ম্যানেজার ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. দাউদ আদনানের দাবি ক্রস ম্যাচিংয়ের পূর্বে হোল ব্যাগ রক্ত নেয়া আইনগতভাবে বৈধ। রক্ত নেয়া বা দেয়ার ক্ষেত্রে ডবিস্নউএইচও এই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। তবে কিছু বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র রোগীদের বাড়তি মনোযোগ ও আস্থা অর্জনে স্যাম্পল নেয়ার পর ক্রস ম্যাচিংসহ অন্যান্য কাজ শেষে রক্ত নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রোগীর দ্রম্নত রক্ত প্রয়োজন ও দাতাদের তাড়াহুড়ায় সরকারি হাসপাতালের বস্নাড ব্যাংক কিছুটা শিথিলতা দেখাতে পারে। মূলত সেখানে লজিস্টিক সাপোর্টসহ সমন্বয়ের ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে রেডক্রস ও ক্রিসেন্টের মতো সরকারিভাবেও পৃথক বস্নাড ব্যাংক বা আধুনিক অবকাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। যেখান থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুপাতে রক্ত সংগ্রহ করা সহজ হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66830 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1