বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে পরিবহন শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

প্রতিদিনই প্রয়োজনে বা জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে সড়কে নামতে হয় নগরবাসীকে। শুনতে হয় দুর্ঘটনার খবর। তাজা প্রাণের রক্তে ভেজে পিচঢালা রাজপথ। অধিকাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে গণপরিবহনের চাপায় কিংবা ধাক্কায়। দুর্ঘটনার পর সমালোচনা শুরু হয়, দেয়া হয় নানা আশ্বাস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হয় জড়িতদের ধরতে। কিন্তু ফেরে না গণপরিবহনের শঙ্খলা। বন্ধ হয় না বাসে বাসে রেষারেষির প্রবণতা।

ভুক্তভোগী পরিবার, পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে রাজধানীতে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় কিংবা চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন ১৫ জন। গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর বাংলামোটরে ট্রাস্ট পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাসের চাপায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডবিস্নউটিসি) কর্মকর্তা কৃষ্ণা রানী চৌধুরী পা হারান। ওই ঘটনায় বেশ চাঞ্চল্য ছড়ায়। পুলিশ ঘাতক বাসটির চালককে গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু এরপরও ঘটে যায় ডজন খানেক দুর্ঘটনা।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি-আমতলীর মাঝামাঝি মহাখালী উড়ালসড়কের পাশের রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠছিলেন ফারহা। হঠাৎ ক্যান্টনমেন্ট মিনিবাস সার্ভিসের একটি বেপরোয়া গতির বাস ধাক্কা দেয় বিদু্যতের একটি খুঁটিতে। সেখানে দাঁড়ানো এক যুবক ছিটকে পড়ে যান। এরপরও রক্ষা পাননি দাঁড়িয়ে থাকা ফারহা। ফুটপাত ঘেঁষে বাসটি মুহূর্তেই ধাক্কায় দেয় ফারহা নাজকেও। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক জানান, ঘটনাস্থলেই ফারহার মৃতু্য হয়েছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন ফারহা। চার বছর আগে বিয়ে হয় পলস্নী বিদু্যতের কর্মকর্তা নাজমুল হাসানের সঙ্গে। রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর এলাকায় থাকতেন তিনি। দেড় বছরের মেয়ে তাহরিন হাসান ইশরা এখন মাতৃহারা।

ফারহা নাজের মৃতু্যর দিনই অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তুরাগে ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের বাসের ধাক্কায় সংগীত পরিচালক ও সুরকার পারভেজ রব নিহত হন। একই পরিবহনের অপর একটি বাসের চাপায় গত ৭ সেপ্টেম্বর পারভেজ রবের সন্তান আলভী আহত এবং আলভীর বন্ধু মাহমুদ নিহত হন।

একইদিন রাত আড়াইটার দিকে উত্তরার কামারপাড়ায় বাসের ধাক্কায় রাশেদ হাওলাদার (২০) নামের এক ট্রাক হেলপার নিহত হন।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডেমরায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় কামরুল হাসান ওরফে সানি (২৬) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। কামরুল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন।

প্রাণ হারানোর অনিবার্য এ অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না স্বয়ং পরিবহন শ্রমিকদেরও। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মাতুয়াইল এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সহকারী আবদুল কুদ্দুস (৪৫) নিহত হন। একই ঘটনায় আহত হন বাসটির সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান (৩৫)।

গত ১৩ আগস্ট রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় একটি বাসে উঠতে যান মো. সেলিম (৩৩) নামের এক যুবক। এ সময় পাশ দিয়ে আরেকটি বাস এসে তাকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান সেলিম। ২২ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় হোমনা পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা বাবা ইমারত হোসেন (৪৮) নিহত হন। আহত হন আবদুল হাদী ওরফে ইমন (২২)। আহত হাদী ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। নিহত ইমারত নারায়ণগঞ্জ ইপিজেড দইয়েজস্টার বাটন কোম্পানির গুদাম ব্যবস্থাপক ছিলেন।

গত ২৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কায় লাশ হয়ে ফেরেন বাবা আফছার উদ্দিন (৫৮)। তিনি বংশালের মকিম বাজার এলাকার বাসিন্দা। তার মোটরসাইকেলের হেলমেটের ব্যবসা ছিল।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের তথ্যানুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় গত পাঁচ বছরে ১২ হাজার ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলাসমূহের নিষ্পত্তির জন্য আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত আছে।

সম্প্রতি ঢাকার গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) মাসিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে জানানো হয়, চলতি বছরের গত আট মাসে দুই হাজার ৮০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮৪ নারী ও ৪৭৮ শিশুসহ তিন হাজার ৭৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হন পাঁচ হাজার ৬৯৭ জন।

গত ২৫ আগস্ট 'নিরাপদ সড়ক চাই' (নিসচা) এক প্রতিবেদনে জানায়, পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটিতে নয়দিনে সারা দেশে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩৫টি। এতে নিহত হন ১৮৫ জন এবং আহত হন ৩৫৫ জন। এর মধ্যে শুধু সড়কেই ১৩০টি দুর্ঘটনায় ১৮০ জন নিহত ও ৩৪৪ জন আহত হন।

সড়কে অনাকাঙ্ক্ষিত এমন মৃতু্যর মিছিলের বিষয়ে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, শৃঙ্খলার মধ্যে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে না। বিশৃঙ্খলা হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে আপনি-আমি যে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারি।

'এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি শুধু পরিবহনের কারণেই নয়; পথচারী, বেপরোয়া বাইক, সিএনজি কিংবা প্রাইভেট কারের কারণেও ঘটে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনার মধ্যেই কেবল বন্ধ হতে পারে প্রাণহানির ঘটনা।'

এ প্রসঙ্গে এনা পরিবহনের মালিক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এ প্রাণহানির ঘটনায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিক কেউই দায় এড়াতে পারেন না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও অনেক কিছু জরুরি।

'সারাদেশে পরিবহন সেক্টরের অবস্থা খারাপ নয়। রাজধানীর দুর্ঘটনা সর্বত্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। এসব বন্ধে পরিবহন মালিকপক্ষ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চালক-শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। টিকিট কাউন্টার স্থাপন, নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামানো এবং যাত্রী নামানোর জন্য বাস বে নির্মাণের কাজ চলছে। আমি বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকে অনুরোধ করব, যারাই সড়কে আইন অমান্য ও বেপরোয়া হয়ে বাস চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে, তাদের বিরুদ্ধে যেন আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।'

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সড়কে শৃঙ্খলা আনা ও দুর্ঘটনা কমাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে গত ৫ সেপ্টেম্বর একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ টাস্কফোর্সে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থাকবেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় ১১১ দফা সুপারিশ উত্থাপিত হয়। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে এ টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

বিআরটিএ'র পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, টাস্কফোর্স গঠন ও কার্যকর হলে দুর্ঘটনা কমবে ও সড়কে শৃঙ্খলা দৃশ্যমান হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী আমরা। কিন্তু যেখানে বিনিয়োগ ছাড়া শুধুমাত্র সিস্টেম ডেভেলপ করে সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব সেখানে আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে।

'দুর্ঘটনা ঘটবে না- এমন সুন্দর উদাহরণ রাজধানীতেই আছে। ঢাকা, কিংবা হাতিরঝিল চক্রাকারের মতো এক কড়িডোরে, এক কোম্পানির অধীনে রাজধানীর পরিবহন সেক্টরকে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে প্রতিযোগিতা থাকবে না, যাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না। যাত্রী না থাকলেও চালকরা বেতন পাবেন। এ ধরনের পরামর্শ ২০০৫ সালে, ২০১৩ সালেও দেয়া হয়েছে।'

সরকারের নির্বাহী মহলে গাদা গাদা পরামর্শ লিপিবদ্ধ। বিস্তৃত পরিসরে চালু করা গেলে পুলিশ ছাড়া, মালিক ছাড়া, নিয়ন্ত্রণ ছাড়া স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিবহন চলবে। তখন দুর্ঘটনা ঘটবে না। এটা করা না গেলে হাজারও কমিটি করেন, টাস্কফোর্স গঠন করেন, কোনো লাভ হবে না- বলেন শামসুল হক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66828 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1