বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ

গ্রামে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের উদ্যোগ নেই

পশুর বর্জ্য দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে বায়ু-পানি দূষণসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর পোকা তৈরি হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপজেলার গন্ডি পার হয় না
নতুনধারা
  ১১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

ফয়সাল খান

পশু কোরবানি করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার কোরবানির বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে সিটি করপোরেশন। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনও দ্রম্নততম সময়ে বর্জ্য অপসারণে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু গ্রামের কোরবানির বর্জ্য অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ প্রতি কোরবানির ঈদেই গ্রামে সবচেয়ে বেশি পশু জবাই করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে গ্রামগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি। যার যার বাড়ির আঙিনা, খোলা মাঠ, পতিত জমি, নদী, পুকুর বা ডোবার মতো জায়গায় গৃহস্থালিসহ প্রায় সব ধরনের বর্জ্য ফেলা হয়। বেশির ভাগ মানুষ সচেতন না থাকায় কোরবানির পশুর বর্জ্যও একইভাবে যেখানে সেখানে দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। এতে বায়ু ও পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। জন্ম নেয় নানা কীটপতঙ্গ ও ক্ষতিকারক পোকা। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সারাদেশের কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের নির্দেশ দেয়া হলেও তা গ্রাম পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয় না। মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ এবং বিস্তারিত পরিকল্পনা দেয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া কিছু কিছু পৌরসভায় এ কার্যক্রম আংশিক বাস্তবায়ন হলেও দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই কোরবানির পশুর বর্জ্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।

ইউনিয়ন পর্যায়ে কোরবানির বর্জ্য অপসারণ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনকি বেশির ভাগ অঞ্চলে নাগরিকদের সচেতন করার জন্য কোনো ধরনের লিফলেট, ফেস্টুন বিতরণ বা মাইকিংও করা হয় না। ফলে যে যার খুশিমতো পশু কোরবানি করেন। ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে জবাইকৃত পশুর বর্জ্যও ফেলে রাখেন। মূলত কোরবানি করা পশুর বর্জ্য এমন স্থানে ফেলা হয়, যেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়ালেও নিজেদের বাড়িতে আসবে না।

এক্ষেত্রে খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজের মাঠ, বাড়ির আঙিনা, পতিত জমি, পুকুর পাড়, খাল পাড়, নদীর কিনারাও বাদ যায় না। বিগত ঈদগুলোতে বেশকিছু এলাকার স্কুল-কলেজের মাঠে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোরবানির বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হওয়ার পরও মারাত্মভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এসব বর্জ্যের দুর্গন্ধ ছাড়াও নানা ধরনের কীটপতঙ্গ তৈরি হয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে ঈদ করবে এবং পশু কোরবানি করবে। তাই গ্রামে কোরবানি করা পশুর বর্জ্য অপসারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি ছিল। কিন্তু কোনো বছরই এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ডেঙ্গুসহ নানা রোগব্যাধির শঙ্কা থাকায় এবার অন্তত এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। গ্রামকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে রেখে পরিচ্ছন্ন দেশ গড়া অসম্ভব বলেও মত দেন তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। নাগরিকদের কোনো দুর্ভোগের দায় ইউনিয়ন পরিষদ গ্রহণ করে না। তাদের সেই সক্ষমতাও নেই। কোরবানির বর্জ্য অপসারণ বা সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মূলত গ্রামে নাগরিক সেবা বলতে তেমন কিছুই নেই। পরিষদের পক্ষ থেকে যতটুকু দেয়া হয়, ততটুকুই। এতে কারো অভিযোগও নেই। সবাই মেনে নিয়েছে। মনে করছে, এটাই নিয়ম। জনগণের কাছে প্রশাসনের দায়বদ্ধতা না থাকলে নাগরিকরা সেবা পাওয়া যায় না বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও

পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহরে কোরবানির বর্জ্য অপসারণ না হলে বড় একটা বিপত্তি ঘটে। তাই সরকার এটাকে অনেক গুরুত্ব দেয়। কিন্তু গ্রামেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আছে। আগের তুলনায় গ্রামের কোরবানির সংখ্যা অনেক গুণ বেড়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোরবানির বর্জ্য দ্রম্নত সময়ে অপসারণ করা না হলে বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যায়। গ্রম বাদ দিয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ গড়া সম্ভব নয় উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উচিত ইউনিয়ন পরিষদকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা। পুরোপুরি সম্ভব না হলেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সীমিত পরিসরে হলেও, অন্তত চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে নাগরিকদের সচেতন কারার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে, কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, 'যত্রতত্র পশু কোরবানির ফলে বিবিধ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপত্তির সৃষ্টি হয়। এ প্রক্রিয়ায় নানাবিধ বায়ু ও পানিবাহিত রোগ ও দুর্গন্ধ ছড়াও নানারূপ পোকামাকড়ের জন্ম দেয়।' ফলে নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে দেশের সকল সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নিয়ে একটি সভা করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর সিটি করপোরেশন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়। তা ছাড়া সারাদেশে সুষ্ঠুভাবে কোরবানি সম্পন্ন করতে বেশকিছু পরিকল্পনাও দেয়া হয়। এই নির্দেশনার অনুলিপি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভাগীয় কমিশনার ও সকল জেলা প্রশাসকের নিকট পাঠানো হয়।

জানা গেছে, গত ১০ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে সারাদেশে নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানির পশু জবাই ও দ্রম্নত বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সকল জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে সভা করে কোরবানির বর্জ্য অপসারণসহ অন্যান্য কর্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করতে বিভাগীয় কমিশনারের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর জেলা প্রশাসকদেরকে, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ে নিয়মিত সভা করে কোরবানির বর্জ্য অপসারণসহ সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে, উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে নিয়মিত সভা করে কোরবানির বর্জ্য অপসারণসহ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বলা হয়।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ কোরবানির স্থানসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ওয়েবসাইট, ব্যানার, ফেস্টুন, মাইকিংসহ ডিজিটাল ডিসপেস্নতে প্রচার করার কথা থাকলেও তার দেখা মেলেনি খোদ রাজধানী শহরেই। বর্ষাকাল বিবেচনায় কোরবানির স্থানে পশু জবাইয়ের স্থানে সামিয়ানা, ত্রিপল টাঙানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কোরবানি করা পশুর রক্ত অপসারণের জন্য ড্রেনের ব্যবস্থা করাসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন তথা শহর অঞ্চলে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও গ্রামে একেবারে নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, গ্রামের বর্জ্য নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না। শহরের বর্জ্য অপসারণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে বিভিন্ন সভা ছাড়াও মৌখিকভাবে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। অনেক চেয়ারম্যান বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চান না।

তবে চেয়ারম্যানরা বলছেন, বেশির ভাগ সময়েই কোরবানি পশুর বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা বা বরাদ্দ পান না তারা। মাঝেমধ্যে কোরবানির স্থান জানতে চাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে গ্রামবাসী যেসব জায়গায় পশু কোরবানি করেন, সেসব জায়গার নামের তালিকা পাঠিয়ে দেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার তালাজাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান যায়যায়দিনকে বলেন, কোরবানির বর্জ্য অপসারণের জন্য কোনো বাজেট বা জনবল নেই। ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো চাপ নেই। এবার নিজ উদ্যোগে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে স্বল্প পরিসরে কোরবানির কার্যক্রম মিটিং করেছেন বলে জানান তিনি।

গাজীপুর জেলার বরমী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক বাদল সরকার বলেন, ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের কোনো বাজেটও থাকে না। এলাকাবাসী যার যার দায়িত্বে পশু কোরবানি করবেন এবং এর বর্জ্য অপসারণ করবেন বলে জানান তিনি। তা ছাড়া খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ বিভাগের আরও ৫টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একইরকম তথ্য পাওয়া গেছে।

বরিশালের হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পন্ডিত শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছর উপজেলা থেকে নির্দেশনা পেলেও এবার কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করা এবং নাগরিকরা যাতে নিজ দায়িত্বে দ্রম্নত সময়ে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মাসুদ আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কোরবানি পশুর বর্জ্য অপসারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে বর্জ্য নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হয় না বলে দাবি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62187 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1