শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

মৌলভীবাজারের চার রাজাকারের মৃত্যুদÐ

যাযাদি রিপোটর্
  ১৮ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

একাত্তরে মৌলভীবাজারের রাজনগরে গণহত্যা, হত্যা, ধষের্ণর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে তখনকার রাজাকার বাহিনীর চার সদস্যকে মৃত্যুদÐ দিয়েছে আদালত।

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তজাির্তক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

আসামিদের মধ্যে ৭৯ বছর বয়সী আকমল আলী তালুকদার কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বাকি তিন আসামি আব্দুন নূর তালুকদার ওরফে লাল মিয়া (৬৬), আনিছ মিয়া (৮০) ও আব্দুল মোছাব্বির মিয়া (৬৭) পলাতক।

রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা দুটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।

এর মধ্যে রাজনগরে গণহত্যার দায়ে চার আসামির সবাইকে মৃত্যুদÐ এবং দুইজনকে অপহরণ করে আটকে রেখে নিযার্তন ও হত্যার ঘটনায় সবাইকে আমৃত্যু কারাদÐ দেয়া হয়েছে।

মৃত্যু পযর্ন্ত ফঁাসির দড়িতে ঝুলিয়ে চার যুদ্ধাপরাধীর সাজা কাযর্কর করার নিদের্শ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রায়ের পযের্বক্ষণে আদালত বলেছে, ‘সব অপরাধের শীষর্ অপরাধ হলো গণহত্যা। আর রাজনগরে গণহত্যাসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা কেবল একটি জায়গায় কয়েকজন মানুষকে হত্যা করা নয়, পুরো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যারা এ অপরাধ করেছে তারা মানবতার শত্রæ।’

মামলার নথিতে বলা হয়েছে, ওই চারজন একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে রাজনগরের পঁাচগঁাও গ্রামে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান।

তাদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষক আকমল ও লাল মিয়া সে সময় মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আকমল ছিলেন পঁাচগঁাও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য।

২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে লাল মিয়া, আনিছ ও মোছাব্বির পালিয়ে যান। তার আগে তারা জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে প্রসিকিউশনের ভাষ্য।

পলাতক তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে সাজা কাযর্কর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে রায়ে।

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সবোর্চ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক আসামিকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমপর্ণ করতে হবে।

এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এ মামলার প্রসিকিউটর হায়দার আলী বলেন, ‘প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলিয়ে রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, ন্যায় বিচার পেয়েছি।’

অন্যদিকে পলাতক তিন আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামিরা আত্মসমপর্ণ করে যদি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে, তাহলে তারা ন্যায় বিচার পাবেন এবং খালাস পাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’

আন্তজাির্তক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পযর্ন্ত রায় আসা ৩৩টি মামলার ৭৮ আসামির মধ্যে পঁাচজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৭৩ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪৬ যুদ্ধাপরাধীর সবোর্চ্চ সাজার রায় এসেছে।

১৬০ পৃষ্ঠার রায়

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় আদালত বসার পর রাজনগরের চার আসামির রায়ের কাযর্ক্রম শুরু হয়। গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র কামিল মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ আকমল আলী তালুকদারকে ঘণ্টাখানেক আগেই কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়।

তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, এ মামলায় তারা যে রায় দিচ্ছেন, তা ১৬০ পৃষ্ঠার।

পরে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন।

এই চার আসামির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরুর পর ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

ওই দিনই রাজনগরের পঁাচগঁাও গ্রাম থেকে আকমল আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র কামিল মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত এই উপাধ্যক্ষকে পরে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৬ সালের ২৩ মাচর্ এ মামলার চার আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। সেখানে ৫৯ জনকে হত্যা, ছয়জনকে ধষর্ণ, ৮১টি বাড়িতে লুটপাট অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে গত বছরের ৭ মে এ মামলার বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে ৪ জুলাই শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতকর্ শুনানি শেষে গত ২৭ মাচর্ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে আদালত।

প্রসকিউশনের পক্ষে এ মামলার শুনানিতে সৈয়দ হায়দার আলীর সঙ্গে ছিলেন শেখ মুশফিক কবীর ও সায়েদুল হক সুমন।

আর আসামি আকমলের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে ছিলেন আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদার। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান শুনানি করেন।

কোন অপরাধে কী সাজা

এ মামলায় প্রসিকিউশনের ১৩ জন সাক্ষীর মধ্যে পঁাচজনই একাত্তরে আসামিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা আদালতকে বলেছেন। তাদের মধ্যে তিনজন একাত্তরে ধষের্ণর শিকার হন।

আর বারীন্দ্র মালাকার ও সুবোধ মালাকার নামের দুই সাক্ষী সরাসরি আসামিদের নিযার্তনের শিকার হন মুক্তিযুদ্ধের সময়। তারা দুজনই সে সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

মামলার প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মে এ মামলার চার আসামিসহ রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজনগরের পঁাচগঁাও গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫৯ জনকে বেঁধে, পিটিয়ে, গুলি করে হত্যা করে।

ওই গ্রামের ১৩২টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তার আগে লুটপাট চালানো হয় ১০২টি বাড়িতে। ওই গ্রামের বহু নারী সেদিন ধষের্ণর শিকার হন।

রায়ের পর প্রসিকিউটর হায়দার আলী সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল চার আসামিকেই মৃত্যুদÐ দিয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর চার আসামিসহ রাজাকার সদস্যরা রাজনগরের পশ্চিমবাগ গ্রামের চক্রবতীের্দর বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে দুইজনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন দেয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের নিযার্তন করা হয়।

ওই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া বিনোদ চক্রবতীর্ ও নিখিল রঞ্জন চক্রবতীের্ক রাজনগর থানায় আটকে রেখে নিযার্তন করা হয়। পরে তাদের মৌলভীবাজারে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মনু নদীর তীরে বধ্যভূমিতে নিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।

হায়দার আলী বলেন, ‘ওই দুইজনের আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আটকে রেখে নিযার্তনের পর হত্যা করা হয়েছিল। তাদের লাশেরও সন্ধান পায়নি স্বজনরা।

“এই অভিযোগও প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে আসামিদের আমৃত্যু কারাদÐের আদেশ দিয়েছে।”

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<4061 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1