শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বড় ঋণ কেলেঙ্কারির হোতারা এখনো অধরা

ব্যাংকের পরিচালনা পষর্দ, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসায়ী নামের কিছু লুটেরা মিলেমিশে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অথর্ লুটপাট করেছেন মত সংশ্লিষ্টদের
যাযাদি রিপোটর্
  ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অধরাই থেকে যাচ্ছেন দেশের ইতিহাসে বড় কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়কেরা। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনের মারপ্যঁাচে আইনের আওতায় তাদের আনা যাচ্ছে না।

ব্যাংক খাতে জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনায় দুনীির্ত দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত করলেও অদৃশ্য ইশারায় ধরাছেঁায়ার বাইরে রয়ে গেছেন অনেকে। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমাসর্ ব্যাংকসহ কয়েকটি বড় জালিয়াতির হোতা হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা এখনো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে ‘ব্যাংকিং সেক্টর ইন বাংলাদেশ: মুভিং ফ্রম ডায়াগনোসিস টু অ্যাকশন’ শীষর্ক এক প্রবন্ধে বলা হয়, বড় কয়েকটি জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের বড় কয়েকটি ব্যাংক থেকে এ অথর্ লোপাট হয়।

সরকারি-বেসরকারি এসব ব্যাংকে যা হয়েছে, তাকে চুরি নয়, ‘ডাকাতি’ ও ‘হরিলুট’ বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যাংকের পরিচালনা পষর্দ, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসায়ী নামের কিছু লুটেরা মিলেমিশে ভাগ-বঁাটোয়ারার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অথর্ লুটপাট করেছেন।

দুনীির্তবিরোধী আন্তজাির্তক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নিবার্হী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুনীির্তবাজদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় বা সামাজিক অবস্থান বিবেচনা না করে অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নিমোর্হভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে তাদের বিচার করতে না পারলে এ ধরনের অপরাধ কমবে না।

বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি: বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি এবং পরের বছর আরও পঁাচটি মামলা করে দুদক। এসব মামলা করার পর ৪০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অভিযোগপত্র দেয়নি সংস্থাটি। মামলায় ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের আসামি করা হলেও ব্যাংকটির পরিচালনা পষের্দর কাউকেই আসামি করা হয়নি।

বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও অথর্ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকটির পরিচালনা পষের্দর সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পষের্দর সদস্যদের জড়িত থাকার কথা বলা হলেও মামলায় তাদের আসামি করা হয়নি। মামলা হওয়ার পর তদন্ত-পযাের্য় উচ্চ আদালতের নিদেের্শ আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পষের্দর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অভিযোগপত্র এখনো জমা দেয়া হয়নি।

বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় করা মামলাগুলোয় ব্যাংকের কয়েকজন কমর্কতার্ অনেক দিন ধরে কারাগারে। ঋণগ্রহীতা কেউ কেউ ব্যবসায়ী। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা জামিনে বেরিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়েছেন। যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অথর্ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাদের সবাই এখন বাইরে আছেন।

বেসিক ব্যাংকের তদন্ত সম্পকের্ দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, সব আথির্ক দুনীির্তর বিরুদ্ধে কঠোর হবেন তারা।

জনতা ব্যাংকে জালিয়াতি: জনতা ব্যাংকের বড় কেলেঙ্কারি নিয়ে দুদক একের পর এক অনুসন্ধান-তদন্ত চালালেও প্রতিবারই ধরাছেঁায়ার বাইরে থাকছেন হোতারা। দুদক সূত্র জানায়, ২০১২ সালে বিসমিল্লাহ গ্রæপের ঋণ জালিয়াতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয় গ্রাহকদের মধ্যে। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদক কিছু ব্যক্তিকে ‘অভিযুক্ত’ করতে পেরেছিল, যদিও তারা পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। কিন্তু অধরাই থেকে যায় ব্যাংকটির তৎকালীন ঋণ প্রদানকারী ব্যবস্থাপনা কতৃর্পক্ষ। যখনই ব্যাংকটি ওই জালিয়াতির ঘটনার পর ভাবমূতির্ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখনই উদ্?ঘাটিত হয় অ্যাননটেক্স গ্রæপের পঁাচ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। আলোয় আসে ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের চার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি।

এসব কেলেঙ্কারির তথ্য পযাের্লাচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। ২০১২-১৩ সালে উদ্?ঘাটিত বিসমিল্লাহ গ্রæপের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানেও দেখা যায়, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির সুযোগটি তৈরি করে দেওয়া ২০০৮ সালে। ঘটনা চাউর হওয়ার আগেই লাপাত্তা হয়ে যান বিসমিল্লাহ গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান, পরিচালক আনোয়ার চৌধুরী, নওরীন হাসিবসহ ঋণগ্রহীতারা। ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন জনতা, বেসরকারি যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কোনো কোনো কমর্কতার্।

সম্প্রতি উদ্?ঘাটিত অ্যাননটেক্স গ্রæপ, ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গেও বিভিন্ন ব্যাংকের কমর্কতাের্দর জড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলেছে।

জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানপ্রক্রিয়ায় সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে জানান, ব্যাংকটিতে অনেক জালিয়াতির ঘটনাই ঘটেছে, যার দালিলিক প্রমাণ কষ্টসাধ্য। বৃহৎ ঋণগুলোর প্রস্তাব প্রেরণ, একেকটি ধাপ অতিক্রম এবং ঋণ মঞ্জুরের সময়কাল খুব সংক্ষিপ্ত। অথার্ৎ দ্রæতগতিতেই ঋণগুলো মঞ্জুর এবং টাকা ছাড় হয়। এ সময়কালে কমর্কতাের্দর দায়-দায়িত্ব সুনিদির্ষ্ট করলে দেখা যায়, আত্মসাতের সঙ্গে শীষর্ কমর্কতাের্দর যোগসাজশ রয়েছে। অথচ এটি প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে দুদকের ওই কমর্কতার্ আরও জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির সূচনা হয় ২০০৮ সালের দিকে। সে বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পযর্ন্ত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। ওই সময় অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের মতো ঋণগুলো অনুমোদন পায়। ওই আমলে দেয়া ঋণের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি। এসব আত্মসাতের ঘটনায় দুদক এখন অনুসন্ধান শুরু করতে পারছে না।

দুদকের আরেকটি সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধান চলমান থাকলেও ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের ধরা যাচ্ছে না। দুদকের একাধিক অনুসন্ধানে ওই সময়ের ব্যাংকটির শীষর্ নিবার্হীদের নাম এলেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।

ফারমাসর্ ব্যাংকের জালিয়াতি

ফারমাসর্ ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী) কয়েকজন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। কোনো মামলায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে আসামি করা হয়নি।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে ব্যাংকটির সাবেক দুই শীষর্ ব্যক্তির অনিয়ম তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

পরিদশর্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত এ দুজনের সুপারিশেই। আথির্ক লেনদেনের মাধ্যমে তারা নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া ফারমাসর্ ব্যাংক কাযর্ক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অথর্ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তারা।

জালিয়াতির হোতারা আইনের বাইরে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভনর্র খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বড় জালিয়াতির ঘটনাগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করেছে, সরকারের কাছে সব তথ্য আছে। নতুন অথর্মন্ত্রীর কাছে বড় প্রত্যাশার কথা জানিয়ে এই অথর্নীতিবিদ বলেন, নতুন অথর্মন্ত্রী একজন চাটার্ডর্ অ্যাকাউনট্যান্ট। তিনি এ বিষয়গুলো বোঝেন। আমরা চাই সব কটি বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন আছে, সেগুলো পযাের্লাচনা করে প্রয়োজনে নতুন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<32524 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1