শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে তাগিদ

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ফের জট

এখনই রাজনৈতিক পযার্য় থেকে তৎপর না হলে এসব বাজারে বাংলাদেশকে আরও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে
এস এম মামুন হোসেন
  ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

দীঘির্দন পর বাজার খোলার দুই বছর পার না হতেই আবারও জট বঁাধতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে। এরই মধ্যে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে এসব বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক প্রেরণের প্রক্রিয়া। শ্রমশক্তি নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, বিষয়টি নিয়ে এখনই রাজনৈতিক পযার্য় থেকে তৎপর না হলে এসব বাজারে বাংলাদেশকে আরো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এছাড়া বাজারের চাহিদা অনুসারে শ্রমিকদের দক্ষ করার উদ্যোগ না নেয়ায় এরই মধ্যে বাংলাদেশ যেসব সমস্যা মোকাবেলা করছে তা থেকে বের হয়ে আসতে দক্ষ শ্রমিক তৈরিতেও তাগিদ দিচ্ছেন শ্রমবাজার বিশ্লেষকরা।

গত বছরের তুলনায় এ বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক যাওয়ার হার অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। শ্রমিক প্রেরণকারী সংগঠনগুলো বলছে, পযার্প্ত চাহিদাপত্র না পাওয়ায় বিদেশে লোক পাঠাতে হচ্ছে ধীরগতিতে।

জনশক্তি কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ৮ হাজার ২৫ জন শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গেছে। তার মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন, যা ছিল দেশের ইতিহাসে এক বছরের মধ্যে দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের জন্য সবোর্চ্চ কমর্সংস্থানের রেকডর্। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর টাগের্ট নিধার্রণ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কমর্সংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ বছর এখনো পযর্ন্ত বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার যে তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে স্পষ্ট যে লক্ষ্য তো দূরে থাক, ধারেকাছেও পেঁৗছানো সম্ভব হবে না এবার।

গত বছর শুধু সৌদি আরবে চাকরি লাভ করেছিল ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন নারী-পুরুষ। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশটিতে গেছে মাত্র ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৭৭ জন। গত বছর সৌদি আরবে ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন নারী কমীর্ চাকরি লাভ করেছিল। আর চলতি বছরের সাত মাসে সেখানে গেছে ৪৫ হাজার ৫৩৯ জন নারী কমীর্।

দীঘর্ ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০১৬ সালে উন্মুক্ত হয় বহুল আলোচিত সৌদি শ্রমবাজার। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে উন্মুক্ত হওয়ার পর গত বছর বাজারটিতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয়। কিন্তু এর পরের বছরই (চলতি বছর) সবচেয়ে কম শ্রমিক যাচ্ছে দেশটিতে। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে বড় বড় সব শহর নিমার্ণ, প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক কাযর্ক্রম হাতে নেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে সেখানে শ্রমবাজার আরো বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটি। বরং গত বছর তেলের দাম কমে যাওয়ার মধ্যেও রেকডর্ সংখ্যক শ্রমিক যায় দেশটিতে। তবে কিছুদিন আগে এক সাংবাদিকের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশটির অথর্নীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যদিও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনার প্রভাবে এটি ঘটেনি বরং অন্য কোনো কারণে দেশটির বাজারটিতে সমস্যা হয়ে থাকতে পারে।

শুধু সৌদি আরব নয়; কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শ্রমবাজারের অবস্থাও একই রকম। জনশক্তি কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় এক লাখ কম শ্রমিক বিদেশে গেছে। বাহরাইনে ২০১৭ সালে মোট শ্রমিক গেছেন ১৯ হাজার ৩১৮ জন। কিন্তু এ বছরের প্রথম তিন মাসে সেখানে গেছে মাত্র ৩৯১ জন। কুয়েতে বছরখানেক ধরে সব ধরনের শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ প্রায় চার বছর ধরে। এ বছরের এপ্রিলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৯টি ক্যাটেগরিতে কমীর্ নিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোসের্স অ্যান্ড এমিরেটাইজেশনের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। কিন্তু তারপরও কেন দেশটিতে লোকবল প্রেরণ করা যাচ্ছে না তার কোনো উত্তর নেই মন্ত্রণালয় এবং ব্যুরোতে।

কুয়েত, ওমান এবং কাতারের বাজারেও কোনো সুখবর নেই। কী কারণে এসব দেশে কমীর্ যাওয়ার হার হঠাৎ করে এমন কমে গেছে বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে এর মধ্যেও ব্যতিক্রম রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকে সারা বছর যুদ্ধ লেগে থাকলেও দেশটির দূতাবাস থেকে চাহিদাপত্র অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বেশি আসছে বলে জনশক্তি কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সূত্র জানিয়েছে। তবে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না অনেকেই।

বাংলাদেশের অথর্নীতিতে অভিবাসীদের পাঠানো রেমিন্ট্যান্সের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। আর এ রেমিট্যান্সের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার থেকে। আর এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার এ দেশের অথর্নীতির প্রধান চালিকাশক্তি বলে উল্লেখ করছেন অনেকেই। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তার প্রভাব পড়বে পুরো অথর্নীতিতে। আর এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের বিষয়ে রাষ্ট্রের কতার্ব্যক্তিদের আরো সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছে তারা।

এ বিষয়ে বিদেশে লোকবল পাঠানো এজেন্সিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্। এ বাজারের ওপর আমাদের জাতীয় পযাের্য়র অনেক কিছুই নিভর্র করে। ফলে এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হলে তা আমাদেরকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। দীঘির্দন এসব শ্রমবাজারে আমাদের কাযর্ক্রম সীমিত হয়ে পড়েছিল। সব বাধা পেরিয়ে প্রায় তিন বছর আগে তা খুলে যায়। এরপর গত প্রায় আড়াই বছরে আমাদের রেকডর্ সংখ্যক লোকবল এসব দেশে গেছে। কিন্তু এবার সে গতি কিছুটা কম। গতবারের তুলনায় এবার এরই মধ্যে অনেক কম শ্রমিক গেছে এসব দেশে। এর একটি কারণ হতে পারে দেশটিতে এখন আগের মতো আর শ্রমিক প্রয়োজন হচ্ছে না। এছাড়া দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা লোক পাঠাই। কিন্তু আমাদের প্রধান সমস্যা হলো সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক পাঠাতে পারছি না। এ কারণে আমাদের শ্রমিকরা অনেক কম বেতন পাচ্ছে। সরকারি পযার্য় থেকে যদি এগিয়ে আসা হয় তবে বিদেশে পাঠানোর আগে মোটামুটি মানের একটি ট্রেনিং দিয়ে দেশগুলোতে লোকবল পাঠাতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্সের হার মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি করা সম্ভাব হবে। এজন্য সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ প্রয়োজন। এছাড়া যেসব দেশে কম শ্রমিক যাচ্ছে সেসব দেশের কতৃর্পক্ষের সঙ্গেও রাজনৈতিক পযার্য় থেকে যোগাযোগ বাড়ালে সমস্যার একটি সমাধান সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।’

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কমর্সংস্থান মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে সেখান থেকেও ইতিবাচক কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের একজন কমর্কতার্ যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, ‘হঠাৎ করে দেশগুলোতে কম শ্রমিক যাওয়ার কারণ আমাদের কাছেও স্পষ্ট নয়। তবে আমরা মনে করছি গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু করে এ বছরের প্রথম দিকে প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে বিদেশি শ্রমিকদের কাজ দেয়ার ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ দেয়া হয়। তার প্রভাবেই সৌদিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’

তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সে সম্পকের্ কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22554 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1