শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সবুজ কারখানায় বিনিয়োগ করে হতাশ উদ্যোক্তারা

৩০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেও প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের ইমেজ ব্যবহার করে বিদেশি ক্রেতারা নিজেদের বাজার তৈরি করছেন বিশ্বের শীষর্ ১০ কারখানার ৭টিই বাংলাদেশে ১৫ বছরে পোশাকের মূল্য কমেছে ৪০ শতাংশ
ওবায়দুর রহমান
  ১০ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার ইমেজের অপব্যবহার করছেন বিদেশি ক্রেতারা। ক্রেতারা সবুজ কারখানা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দিলেও তৈরি পোশাকের বাড়তি মূল্য দিতে নারাজ । অথচ ক্রেতা টানতে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার ইমেজ ব্যবহার করছেন তারা। বিদেশি ক্রেতাদের এমন আচরণকে অনৈতিক বলছেন বাংলাদেশের সবুজ কারখানার উদ্যোক্তারা।

তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিনিয়োগ অনুযায়ী পোশাকের দাম না পাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কারখানার মালিকরা হতাশায় ভুগছেন। ইতোমধ্যে তারা এ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। পরিবেশবান্ধব এসব কারখানা তৈরির জন্য সাধারণ কারখানার চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অথর্ বেশি ব্যয় করতে হয়; কিন্তু সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছেন না তারা।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আশুলিয়ায় তাজরীন কারখানায় অগ্নিকাÐ ও রানা প্লাজা ধসের পর দেশের তৈরি পোশাক শিল্প মহাসংকটে পড়ে। একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকেন বিদেশি ক্রেতারা। এমনকি দেশের কারখানাগুলো নন-কমপ্লায়েন্স, এমন অভিযোগ তুলে কারখানাগুলোকে বন্ধ করার জোর দাবিও তোলেন তারা। ইউরোপ ও আমেরিকান ক্রেতাদের জোট অ্যাকডর্ ও অ্যালায়েন্স বিভিন্ন সময় পোশাক কারখানাগুলো পরিদশর্ন করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দেয়। এ মহাসংকট থেকে উত্তরণের জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যেও ছিল অস্বস্তি। পরে শ্রমিক ও পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠায় শিল্প মালিকদের নানামুখী উদ্যোগে এ অস্বস্তি এখন নেই বললেই চলে। উদ্যোক্তারা একে একে গড়ে তুলছেন পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা। গত কয়েক বছরে বেশকিছু ‘সবুজ’ কারখানা প্রতিষ্ঠার পর আরও নতুন নতুন কারখানা সবুজায়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে। সামনে আরও ২৮০টি কারখানা সবুজায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন উদ্যোক্তরা।

প্রশ্ন হচ্ছে সবুজ কারখানা করে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কি সুফল পাচ্ছেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সালাম মুশের্দী যায়যায়দিনকে বলেন, বিদেশি ক্রেতারা তাদের উৎসাহ দিচ্ছেন পরিবেশবান্ধব বা সবুজ কারখানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বাংলাদেশের বায়াররা তাদের ক্রেতাদের কাছে পরিবেশবান্ধব কারখানায় পণ্য তৈরি হচ্ছে- এমনটি প্রচার করে তাদের ভাবমূতির্ বাড়াচ্ছে। নিজেদের ব্যবসাকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করছে। এর সুফলও তারা পাচ্ছেন। সচেতন ক্রেতারা তাদের পোশাক বেশি কিনছেন। আমাদেরও এসব কারখানায় প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অথচ ইমেজ বা ভাবমূতির্ ব্যবহার করলেও তারা আমাদের পযার্প্ত দাম দিচ্ছেন না। তারা যখন ক্রয় আদেশ দেয় তখন আন্তজাির্তক প্রতিযোগিতার কথা বলেন। এটি একেবারেই অনৈতিক কাজ বলে মনে করেন সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি।

এদিকে তৈরি পোশাক শিল্পে উন্নতমানের সবুজ কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) নিমাের্ণ সারাবিশ্বে এখন শীষের্ অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এমনটাই দাবি করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল। সংস্থাটির হিসেব মতে, বিশ্বের প্রথম ১০টি উন্নতমানের কারখানার ৭টিরই অবস্থান বাংলাদেশে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ সংগঠনটি বাংলাদেশের ১৩টি পোশাক কারখানাকে প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে ‘লিডারশিপ ইন এনাজির্ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন-লিড’ সনদ দিয়েছে। আর গোল্ড সনদ পেয়েছে ২০টি কারখানা। সিলভার সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ২৭টি। সাধারণভাবে পরিবেশবান্ধব হিসেবে সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ৭টি।

শীষর্স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক ভিয়ালটেক্স গ্রæপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নিবাির্হ কমর্কতার্ কেএম রেজাউল হাসনাত বলেন, বিদেশি ক্রেতারা পরিবেশ বান্ধব কারখানা থেকে পোশাক ক্রয়ের জন্য এক পয়সাও বেশি দাম দিতে চায় না। ভিয়েলটেক্স গ্রæপ গাজিপুরে দুটি পরিবেশ বান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠা না করলে আরও ৩০ শতাংশ বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারত। পরিবেশবান্ধব কারখানা নিমাের্ণর জন্য এখন তার অনুসূচনা হয়। ক্রেতারা একই মানের চীনের কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের জন্য বেশি দাম দিচ্ছে। অথচ আমাদের বেলাই দাম কম! এটা অন্যায়।

বিশ্বের প্রথম প্লাটিনাম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব ডেনিম কারখানার উদ্যোক্তা ও এনভয় গ্রæপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ক্রেতারা পরিবেশ বান্ধব কারখানার জন্য একটি পয়সাও বেশি দেয় না। অথচ বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের পরিবেশবান্ধব কারখানার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানি কারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানা নিমাের্ণ কোনো বাড়তি সুবিধা নেই। শুধু ক্রেতা এ ধরনের কারখানায় ক্রয় আদেশ দিতে অগ্রাধিকার দেয়। তা ছাড়া তারা বাড়তি কোনো সুবিধা দিতে রাজি নয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে অভাবনীয় সংস্কার হয়েছে। এত উদ্যোগের পরও বিদেশি ক্রেতারা গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের পোশাকের মূল্য ৪০ শতাংশ কমিয়েছে।

প্লাটিনাম রেটেড নিটওয়্যার কারখানা প্লামি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব কারখানা থেকে পোশাক কেনার জন্য বেশি টাকা দেয় না। তবে তাদের সাথে দাম নিয়ে দর কষাকষির একটি সুযোগ তৈরি হয়। একটি সাধারণ কারখানায় উৎপাদিত একটি টি-শাটর্ ৩ ডলা মূল্য হলে পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদিত একই পণ্য ১০ সেন্ট বেশি দাম হতে পারে। যদিও বিদেশি ক্রেতারা তাদের বাজেটের বাইরে গিয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানার জন্য বাড়তি কোনো মূল্য দেয় না।

এদিকে প্রতি বছরই সবুজ কারখানায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকর হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী (এপ্রিল-জুন) প্রান্তিকে সবুজ বা পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বেড়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে পরিবেশবান্ধব খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৬২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। যা এর আগের প্রান্তিকে ছিল ২ হাজার ৪৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

সবুজ কারখানায় যা থাকবে : আন্তজাির্তক নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জমির ওপর ফ্যাক্টরি হবে তার অধের্কটাই ছেড়ে দিতে হবে সবুজায়নের জন্য। সবুজ বাগান থাকবে। ফ্যাক্টরির চারপাশে খোলা জায়গা থাকবে। আর ফ্যাক্টরির ভেতরেও থাকবে খোলা জায়গা। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ থাকবে সুন্দর। এক শ্রমিক থেকে অন্য শ্রমিকের দূরত্বও থাকবে বেশ। এছাড়া সব কিছুই অটোমেশনে হবে। ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হবে। থাকবে সোলার প্যানেল, এলইডি লাইট। এছাড়া পানি রি-সাইক্লিনিং হবে।

এছাড়া আন্তজাির্তক নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। ফ্যাক্টরির ভেতরে আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য থাকবে বিশেষ সুবিধা। চিকিৎসা ভাতাসহ রেশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের কারখানায় শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার, শিশুদের জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ, মসজিদ অথবা নামাজ ঘর এবং প্রশিক্ষণ কক্ষ থাকতে হয়। পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার ফলে শতকরা ২৪ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও কমে।

ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের সেরা দশটি গ্রিন ফ্যাক্টরির মধ্যে বাংলাদেশের সাতটি কারখানা স্থান পেয়েছে। সেরা দশের মধ্যে অন্তভুর্ক্ত হওয়া বাংলাদেশের সাত তৈরি পোশাক কারখানা হচ্ছে- এনভয় টেক্সটাইল, রেমি হোল্ডিংস, প্লামি ফ্যাশনস, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, এসকিউ সেলসিয়াস, জেনেসিস ফ্যাশনস ও জেনেসিস ওয়াশিং, এসকিউ কোলবেন্স ও এসকিউ বিরিকিনা। পোশাক খাতের দুনার্ম কাটাতে নানান চেষ্টার পাশাপাশি মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল’ থেকে ধারণা নিয়ে দেশে গ্রিন ফ্যাক্টরি তৈরি করছেন উদ্যোক্তারা। এখন ওই কাউন্সিলের সাটিির্ফকেট নিয়েই নতুন যাত্রা শুরু করেছে দেশের পোশাক খাত।

উদ্যোক্তারা জানান, গ্রিন ফ্যাক্টরি করতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন। একটি ফ্যাক্টরি করতে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এর পাশাপাশি জমিও লাগে প্রায় ৩ থেকে ১০ বিঘা। তারা জানান, এ পযর্ন্ত দেশে যেসব কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরির খেতাব জিতে নিয়েছে, তাদের বেশির ভাগ উদ্যোক্তার বিনিয়োগই ৫০০ কোটি থেকে ১১০০ কোটি টাকার মধ্যে ছিল। তাদের মতে, গ্রিন ফ্যাক্টরির স্বীকৃতি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত¡াবধানে নিমার্ণ থেকে উৎপাদন পযর্ন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সবোর্চ্চ মান রক্ষা করতে হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<21818 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1