শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পস্নাজমা থেরাপি

অ্যান্টিবডির মাত্রা না জেনে প্রয়োগে সুফল মিলছে না

যাযাদি ডেস্ক
  ১১ জুলাই ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১১ জুলাই ২০২০, ১০:১৪
রোগীকে পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বাইরে পস্নাজমা থেরাপি দিতে নিরুৎসাহিত করা হলেও স্বজনদের আগ্রহে বিভিন্ন হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অনেককে এ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তাদের একটি অংশকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এ পদ্ধতির কার্যকারিতা এখনও পরীক্ষাধীন। তাছাড়া সংক্রমণের শুরুর পর্যায়ে রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত ঘনত্বের অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ পস্নাজমা দিতে না পারলে এ চিকিৎসায় সাফল্যের আশা কম। অভূতপূর্ব এই বৈশ্বিক মহামারিতে লাখ লাখ রোগী সামলাতে হিমশিম খাওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ আক্রান্তদের চিকিৎসায় সেরে ওঠা ব্যক্তিদের রক্তের পস্নাজমা (কনভালেসেন্ট পস্নাজমা) প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশে পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করার সম্ভাব্যতা দেখতে এপ্রিলের শুরুতে আগ্রহের কথা জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজির অধ্যাপক ডা. এম এ খান। এরপর ১৯ এপ্রিল তাকে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই কমিটির অধীনে পস্নাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এই কমিটি নির্ধারিত প্রোটোকল মেনে পরীক্ষামূলকভাবে ৯০ জন রোগীর শরীরে পস্নাজমা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগে এর ফলাফল তারা প্রকাশ করতে চান না। তবে পস্নাজমা কোন পর্যায়ে প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতাল আলাদা একটি গবেষণা চালাচ্ছে। এই দলের সদস্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল আলম বলেন, তাদের গবেষণা কাজের বাইরেও এ পর্যন্ত ১৪৪ জনের ওপর পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগের তথ্য তারা পেয়েছেন। পস্নাজমা দেওয়ার পরও তাদের মধ্যে ২৭ জনের মৃতু্য হয়েছে। পস্নাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব না জেনে সঠিক সময়ে ও সঠিক রোগীর শরীরে তা প্রয়োগ না করায় অনেক ক্ষেত্রে এই থেরাপির সুফল মিলছে না বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তাছাড়া সবার যে এটা কাজে লাগবে, সে বিষয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই। 'শতভাগ নিশ্চিত নয় বলেই বিষয়টা নিয়ে প্রায় একশ বছর ধরে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কখনোই ফার্স্ট লাইন ট্রিটমেন্ট হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হয়নি। এটা সবাইকেই নিরাপদ করতে পারবে না। 'যদি আমরা উপযুক্ত সময়ে পস্নাজমা প্রয়োগ করতে পারি তাহলে ওই রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কিন্তু এমন নয় যে তিনি একশভাগ নিরাপদ হয়ে যাবেন। এমনও হতে পারে তিনি অন্য কোনো সমস্যায় ভুগতে পারেন।' কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১৩ জনকে পস্নাজমা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৫ জন পুলিশ সদস্য বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের পরিচালক ড. হাসান উল হায়দার। তিনি বলেন, পস্নাজমা দেওয়া ৪৫ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। যারা মারা গেছেন, তাদের অবস্থা খুব সংকটজনক ছিল। তাদের ফুসফুসে সংক্রমণ ছিল, তারা ভেন্টিলেশনে ছিলেন এবং প্রচুর অক্সিজেনের দরকার হয়েছিল। 'পস্নাজমা থেরাপি আগেভাগে দিলে আউটপুট ভালো পাওয়া যায় বলে আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছি। আর যারা বেঁচে যাচ্ছেন, সেটা যে পস্নাজমার কারণে বিষয়টি এমন নাও হতে পারে। কারণ পস্নাজমার সঙ্গে আমরা অন্যান্য ওষুধও দিচ্ছি। এটা এখনও গবেষণালব্ধ নয়, এগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।' গত ১৫ জুন রাতে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান। সিএমএইচে ভর্তি কামরানকে ২০০ মিলিলিটার পস্নাজমা দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তার ছেলে ডা. শিপলু কামরান। শিপলু বলেন, 'আব্বার ফুসফুসের প্রায় ৭০ শতাংশ আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে পস্নাজমা থেরাপির ফল আসলে বুঝতে পারি নাই।' ১৪ জুন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের স্ত্রী। তাকেও পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া হয়েছিল। ৩১ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন আহমেদ মারা যান। রাজধানীর গ্রিনলাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন আহমেদকে পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া হয়েছিল। পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগ করলেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠবেন- বিষয়টি এমন নয় বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক এম এ খান। বাংলাদেশে পস্নাজমা থেরাপির প্রয়োগ নিয়ে গঠিত কমিটির প্রধান ডা. খান বলেন, 'আমাদের দেশে বেশিরভাগ রোগীকে পস্নাজমা দিচ্ছে ভেন্টিলেশনে যাওয়ার পর, আইসিইউতে যাওয়ার পর। তখন আসলে পস্নাজমার কোনো গুরুত্ব বা সুবিধা নাই। পস্নাজমা দিতে হয় রোগটি ধরা পড়ার শুরুতে, যেটাকে ভাইরাল ফেইজ বলি। পস্নাজমা যেহেতু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যদি সময়মত দেওয়া যায়।' ডা. খান বলেন, থেরাপির আগে পস্নাজমায় অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরিমাপ করা জরুরি হলেও বাংলাদেশে তা করা হয় না। পস্নাজমায় সঠিক ঘনত্বের অ্যান্টিবডি না থাকলে তেমন কাজ হবে না। রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে পস্নাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদন্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস। অ্যান্টিবডি, যা ইমিউনোগেস্নাবলিন নামে পরিচিত, এমন এক ধরনের সুরক্ষা প্রোটিন, যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে তৈরি হয়। পস্নাজমায় এই অ্যান্টিবডির ঘনত্ব কী মাত্রায় আছে তা আইজিজি (ওসসঁহড়মষড়নঁষরহ এ-ওমএ) পরীক্ষায় পরিমাপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) বলছে, করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীর পস্নাজমা (কনভালেসেন্ট পস্নাজমা) আক্রান্তের শরীরের প্রয়োগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির ঘনত্ব বা আইজিজির মাত্রা ১:৩২০ এর বেশি হতে হবে। ডা. আশরাফ বলেন, 'বাংলাদেশে মানুষের শরীরে আইজিজি ১:৩২০ পর্যন্ত পাওয়া খুবই কঠিন। এ কারণে আইজিজি ১:১৬০ মাত্রায় পেলেই আমরা রোগীদের প্রয়োগ করছি।' বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে