শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যায় পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০
কুমিলস্নার দাউদকান্দিতে মেঘনার ভাঙনে হুমকির মুখে রামপ্রসাদ চর -যাযাদি

দেশের বিভিন্ন নদীতে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধির ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে বিভিন্ন সড়ক, তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষ। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- নাটোর : নাটোরে আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিংড়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে নাটোরের সিংড়া-তেমুক নওগাঁ সড়ক। এতে করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাস্তা ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় বাড়িঘরে ঢুকে পড়ছে পানি। বালুর বস্তা দিয়ে সড়কটির বাকি অংশ বাঁচানোর চেষ্টা করছে স্থানীয় এলজিইডি অফিস। এলাকাবাসী জানান, ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে তীরের ও নিম্নাঞ্চলে লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ছোট ছেলেমেয়ে ও গৃহপালিত পশু নিয়ে বিপদে পড়েছেন এলাকার মানুষ। এছাড়াও গত দুই মাস আগেই তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সিংড়া-তেমুক নওগাঁ সড়কটি। কিন্তু গতকাল ভোরের দিকে বন্যার পানির তীব্রতায় সড়কটির ভাগনগরকান্দি এলাকার দুটি স্থানে অন্তত ১০ মিটার করে ভেঙে যায়। এতে করে তীব্র গতিতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। কাউনিয়া (রংপুর) : রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তার শাখা মানস নদীর জলের প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে বাঁশের সাঁকো। চরাঞ্চলের মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা বাঁশের সাঁকো ভেঙে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন দশ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয় লোকজন জানান, উপজেলার হারাগাছ গোন্ডেনঘাট এলাকায় তিস্তার চরাঞ্চলের চরচতুরা, চরপলস্নীমারী, চরচারমাথা, চরমিলনবাজার, চরকলমদারটারী, চরচিনাতুলী, চরকাউয়াটারী, চরহরিণচড়া, চরটাংরী গ্রামের মানুষ চলাচলের জন্য সবাই মিলে চাঁদা উঠিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তিস্তার মানস নদীতে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করেন। সোমবার রাত ৯টার দিকে মানস নদীতে পানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়ে তীব্র স্রোতে চরাঞ্চলের ১০ গ্রামের মানুষের চলাচলে একমাত্র ভরসা বাঁশের সাঁকোটি ভেঙে যায়। সাঁকোর উপর দিয়ে পারাপার হওয়ার সময় বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নদীতে পড়ে যান। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করেন। সাঁকোটি ভেঙে যাওয়ায় উপজেলার সঙ্গে ১০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মান্দা (নওগাঁ) : নওগাঁর মান্দায় আত্রাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। তবে বানভাসি মানুষের সাহায্যার্থে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে মান্দার নুরুল্যাবাদ ইউপির জোতবাজার-ত্রিমোহনী এলাকায় ফকিন্নি নদীর ব্রিজের পূর্বে মাসলোটা পাড়া এলাকায় আত্রাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পার নুরুল্যাবাদসহ অসংখ্য গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবল স্রোতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নতুনভাবে আরও বিভিন্ন গ্রাম পস্নাবিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩ শতাধিক পরিবারের প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। এ অবস্থায় ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছেন বন্যাকবলিত অসহায় মানুষজন। বেড়িবাঁধের আরও কিছু স্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে রাত জেগে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদিকে, বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ধান, পাটসহ নানা ফসলাদিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বানভাসি মানুষেরা। এ অবস্থায় বানভাসি মানুষের পাশে প্রশাসনকে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী দুই থেকে তিন দিন এ অঞ্চলে বন্যার আরও অবনতি হতে পারে। ইসলামপুর (জামালপুর) : যমুনা নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের ইসলামপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি বেড়ে বুধবার সন্ধ্যায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রতিদিনই যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীর পানি বেড়ে নদী তীরবর্তী এলাকা ছাড়াও বিস্তৃর্ণ জনপদে পানি ছড়িয়ে পড়ছে। উপজেলার অন্তত ৮টি ইউনিয়ন পৌরসভার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, নলকূপ বন্যার পানিতে তলিয়ে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। প্রথম দফার বন্যায় পাওয়া ত্রাণ সহায়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বন্যাদুর্গতরা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন উঁচু বাঁধ, সেতু এবং সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গত পশ্চিমাঞ্চলের সড়কে পানি উঠে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দিরাই (সুনামগঞ্জ) : হাওড় অঞ্চল হিসেবে খ্যাত দিরাই উপজেলায় নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। গত কয়েকদিন ধরে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এতে করে উপজেলার রাস্তা-ঘাটসহ বেশ কিছু বাড়িঘর তালিয়ে গেছে। জানা যায়, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টি সুনামগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে করে সুরমা ও কালনী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ঘরবাড়ি রেখে চলে গেছেন বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সফি উলস্নাহ বলেন, 'বৈশ্বিক মহামারির সংকটময় মুহূর্তে বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক স্যার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।' ছাতক (সুনামগঞ্জ) : টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পানিতে পস্নাবিত হয়েছে পুরো ছাতক উপজেলা। পানিবন্দি হয়ে পড়েন উপজেলার প্রায় দু'লক্ষ মানুষ। দু'সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় সৃষ্ট এ বন্যায় জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। পস্নাবিত এলাকার লোকজন বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় পাকা ও কাঁচা রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় মানুষজনকে চলাচলে পোহাতে হচ্ছে মারাত্মক দুর্ভোগ। ছাতকে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও এখনো নিমজ্জিত রয়েছে অনেক ঘরবাড়ি। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বানভাসি মানুষ। পুরোপুরি চালু হয়নি জেলা ও উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ। শ্রমিক ও দিনমজুররা রয়েছেন বেকার। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। বন্যার পানির তোড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে এখানের সড়ক যোগাযোগ। কোনো কোনো এলাকায় পানি নেমে গেলেও কাদা ও ভাঙা ব্রিজ, কালভার্ট ও রাস্তার কারণে মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ বেড়েছে। দাউদকান্দি (কুমিলস্না) : কুমিলস্নার মেঘনা উপজেলার চালিয়াভাঙ্গা ইউনিয়নে প্রতি বছরই বর্ষার মৌসুমে মেঘনা নদীর ভাঙনের কবলে দিন দিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ওই ইউনিয়নের গ্রামীণ জনপদ। মেঘনা উপজেলার চালিয়াভাঙ্গা নলচক, ফরাজিকান্দি, মৈষারচর, চালিয়াভাঙ্গা, রামপ্রসাদেরচরের মানুষ বর্ষা মৌসুম এলেই আতঙ্কের মধ্যে দিন এবং রাত যাপন করেন। কখন শুরু হয় নদীর ভাঙন- থাকতে হয় সে টেনশনে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত ১০ বছরে প্রায় ২০০ বসতঘর, ফসলি জমি, মসজিদ মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে