বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাবার কবরে শেষনিদ্রায় ড. আনিসুজ্জামান

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৬ মে ২০২০, ০০:০০
শুক্রবার সকালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লাশ দাফন করার আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় -যাযাদি

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার সকালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরে শেষনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার দেন জেলা প্রশাসনের পক্ষে ধানমন্ডি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রবিউল আলম। সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক আবদুর রহমান, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান বলেন, বেলা পৌনে ১১টায় তার বাবার দাফনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এর আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দাফনের সময় পরিবারের পক্ষে তিনি, চাচা

আখতারুজ্জামান এবং ভগ্নিপতি আজিমুল হক উপস্থিত ছিলেন। সকাল সাড়ে ৯টার পর সিএমএইচ থেকে তার বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়।

দাফনের আগে আজিমপুর কবরস্থানেই সীমিত পরিসরে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জানাজা পড়ান মাওলানা ফরিদউদ্দিন আহমেদ। প্রয়াত আনিসুজ্জামানের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতির কারণে কুলখানির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

আজিমপুরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় আনন্দ জামান তার বাবার বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা ও নানা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

গত ১৪ মে বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃতু্যর পর করোনা শনাক্ত হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। সম্প্রতি তিনি বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তার ছেলে আনন্দ জামান জানান, গত ২৭ এপ্রিল তার বাবাকে চিকিৎসার জন্য ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার উচ্চরক্তচাপ এবং হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও কিডনিতে সমস্যা ছিল। অবস্থার অবনতি হলে ৯ মে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল তার জ্বর আসে, বুকের ব্যথাও বাড়ে। সব মিলিয়ে অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল তার চিকিৎসা করছিল।

পারিবারিক সূত্র জানায়, মৃতু্যর পর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাতে তার দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। এর আগে ১০ মে হাসপাতালে তার করোনা পরীক্ষায় ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করে পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তার বাবা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন সুখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও তার লেখালেখির ভালো হাত ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামান ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিতা জামান, শুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামানসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন আনিসুজ্জামান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়েছেন। দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে এবং তারপর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) পড়েন। ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। পরে তিনি 'ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)' শীর্ষক গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইয়ংবেঙ্গল ও সমকাল' বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।

পেশাগত জীবন তিনি শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে ১৯৫৯ সালে। এরপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যুক্ত হন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আনিসুজ্জামান ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের পর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সব শেষ তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যুক্ত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা 'কালি ও কলম'-এর সঙ্গেও।

পুরস্কার ও গ্রন্থ

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৮৫ সালে 'একুশে পদক', ২০১৫ সালে 'স্বাধীনতা পুরস্কার' এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাকে 'পদ্মভূষণ' পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার 'আনন্দ পুরস্কার', রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ডি-লিট', কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী' পদকসহ দেশ-বিদেশে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।

তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, স্বরূপের সন্ধানে, পুরনো বাংলা গদ্য, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, কালনিরবধি, বিপুলা পৃথিবী, আমার একাত্তর ইত্যাদি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<99704 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1