শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যান্ডম টেস্টে করোনা রোগী আরও বাড়বে

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৬ মে ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১৬ মে ২০২০, ০০:০৫
করোনাভাইরাস

শুধু জ্বর-কাশি-গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভোগা অসুস্থ মানুষের নমুনা পরীক্ষা না করে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত উপসর্গহীন আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মীসহ নানাভাবে সংস্পর্শে আসা অন্য ব্যক্তিদেরওর্ যান্ডম করোনা টেস্ট করা হলে শনাক্ত রোগীর হার আরও বহুগুণে বাড়বে। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৩ মে পর্যন্ত প্রায় এক মাসের নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এবং তাদের ধরন বিশ্লেষণে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা এমনটাই আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে গত প্রায় দুই সপ্তাহের পরিসংখ্যান চিত্রে এ আলামত অনেকটাই স্পষ্ট বলে জানিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পহেলা মে ৫ হাজার ৫৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয় ৫৭১ জন। যার মধ্যে উপসর্গহীন সন্দেহভাজন ৬৯ জনের শরীরে করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। এ হিসাবে উপসর্গহীন রোগীর হার ১২.০৮ শতাংশ। ২ মে করোনা শনাক্তকৃত ৫৫২ জনের মধ্যে উপসর্গহীন ছিল ৫৩, অর্থাৎ উপসর্গহীন রোগীর হার ৯.৬০ শতাংশ। এছাড়া ৩ মে শনাক্তকৃত ৬৬৫ জনের মধ্যে ৫৮, ৪ মে শনাক্তকৃত ৬৮৮ জনের মধ্যে ৭১, ৫ মে শনাক্তকৃত ৭৮৬ জনের মধ্যে ৬৬, ৬ মে শনাক্তকৃত ৭৯০ জনের মধ্যে ৬৯, ৭ মে শনাক্তকৃত ৭০৬ জনের মধ্যে ৫৭, ৮ মে শনাক্তকৃত ৭০৯ জনের মধ্যে ৬১, ৯ মে শনাক্তকৃত ৬৩৬ জনের মধ্যে ৫৪, ১০ মে শনাক্তকৃত ৮৮৭ জনের মধ্যে ৮২, ১১ মে শনাক্তকৃত ১ হাজার ৩৪ জনের মধ্যে ৮৪, ১২ মে শনাক্তকৃত ৯৬৭ জনের মধ্যে ৫৯ এবং ১৩ মে শনাক্তকৃত ১ হাজার ১৬২ জনের মধ্যে ৮৯ জন উপসর্গবিহীন ব্যক্তির শরীরে করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। এদের বেশিরভাগেরই শরীরে করোনাভাইরাসের তেমন জোরালো কোনো উপসর্গ না থাকলেও নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহকর্মীদের শরীরে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়ার পর সন্দেহের বশভর্তি হয়ে তারা টেস্ট করিয়েছেন। কেউবা প্রাতিষ্ঠানিভাবে নমুনা পরীক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া এ তালিকায় টানা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর রুটিন চেকআপ করাতে গিয়ে করোনা পজেটিভ ধরা পড়া চিকিৎসক-নার্স রয়েছেন। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরসহ দেশের ৫ হটস্পটের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রাম-গঞ্জে বিপুলসংখ্যক উপসর্গহীন করোনা রোগী রয়েছে। আবার মৃদু উপসর্গ থাকা অসংখ্য মানুষ নানা ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার ভয়ে যথাসময়ে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। এছাড়া সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কায় জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টসহ করোনার নানা উপসর্গ নিয়ে অনেকে গোপনে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। শুধুমাত্র গুরুতর অসুস্থ হলেই তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে বাধ্য হয়ে নমুনা পরীক্ষা করছেন। এ অবস্থায় সব ধরনের অব্যবস্থা ও সঙ্কট দূর করে র্'যান্ডম টেস্ট' করা হলে শনাক্ত রোগীর হার নিঃসন্দেহে আরও বহুগুণে বাড়বে। এতে প্রাথমিকভাবে কিছুটা ধাক্কা লাগলেও দেশে করোনা প্রকোপের ঊর্ধ্বগতির লাগাম দ্রম্নত টেনে ধরা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পরিসংখ্যান চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে সেখানে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মাথায় এ মরণব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। যা কয়েক সপ্তাহ চলমান থেকেছে। পরে সেখানে সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে কমেছে। অথচ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৪৫ দিনের মাথায় মাত্র ৪ হাজারের কিছু বেশি রোগী শনাক্ত করা হয়। অথচ পরবর্তীতে করোনার গুরুতর উপসর্গ থাকা রোগীর পাশাপাশি মৃদু উপসর্গ এবং তাদের সংস্পর্শে আসা উপসর্গহীন কিছু মানুষের নমুনা পরীক্ষা শুরুর পর এ সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। যদিও সে হারও স্বাভাবিক নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই সংখ্যাটি কেন স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে না তা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বরং এ বিষয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলছেন, দেশে টেস্ট করানোর মেকানিজমটা এতদিনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং সেটা পুরোপুরি সচল হওয়া দরকার ছিল। অথচ এই পরীক্ষার মেকানিজম কতটা সচল হয়েছে সেটা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। তার মতে, 'যে নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে বা যারা লক্ষণ নিয়ে পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন তারা যদি করোনাভাইরাস সংক্রমিত না হয়ে থাকেন তাহলে বলা হচ্ছে যে তার করোনা নেই। কিন্তু তাহলে তার মধ্যে লক্ষণগুলো অন্য কী কারণে দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি আর পরিষ্কার করা হচ্ছে না।' এদিকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলে নমুনা সংগ্রহ করা। আর নমুনা যখন সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ, পরিবহণ এবং পরীক্ষার জন্য যখন ডিএনএ এক্সট্র্যাক্ট করা হচ্ছে সেই জায়গায় কোনো ঘাটতি আছে কিনা সেটাও একটা ইসু্য। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আগের তুলনায় দেশে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও পরীক্ষা করার সুযোগ মানুষ কতটা পাচ্ছে? সেখানে কি শুধুমাত্র উপসর্গ থাকা মানুষ নমুনা পরীক্ষা করতে পারছে, নাকি উপসর্গহীনদের টেস্ট করা হচ্ছে? এছাড়া যাদের মধ্যে লক্ষণ বা উপসর্গ রয়েছে তারা পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন কি না বা তাদের মধ্যে কোনো স্টিগমা আছে কি না সে বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন অনেকের মধ্যেই করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে যাদের মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই। আর এ কারণেই যে সংখ্যক রোগী রিপোর্টেড হওয়ার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না। ফলে আন্ডার রিপোর্টিংটা অনেক বেশি। তাদের ভাষ্য, যত রোগী রিপোর্টেড হয় তার আটগুণ রোগী এমনিতেই থাকে। তাই এ হিসাব ধরেই সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। অথচ তা না করে অনেকেই এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। যা করোনা মোকাবিলার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তারা। এদিকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন যে উচ্চহারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে এটিকেই পিক (সর্বোচ্চ) সংক্রমণের সংখ্যা বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এটি আরও লাগামহীনভাবে উর্ধ্বমুখী এবং প্রলম্বিত হবে। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল হওয়ার পর দুই সপ্তাহ পার হলেও এসব খাতের খুব সীমিত সংখ্যক মানুষকে নমুনা পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। এদের ব্যাপকহারে টেস্ট করা হলে তখনই শুধু বোঝা যাবে যে আসলে সংক্রমণ কতটুকু বেড়েছে। এছাড়া ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সারাদেশে বিপুল সংখ্যক মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতান খুলে দেওয়ায় এবং সেখানে সামাজিক দূরত্ব না মেনে ক্রেতাদের ঢল নামায় করোনার সংক্রমণ নিঃসন্দেহে বেশকিছুটা বাড়লে তা আরও কিছুদিন পর টের পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা (পিক) মে মাসে হবে, নাকি সেটি জুন মাস গড়াবে এবং আসলে কতটা উচ্চতায় উঠবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো প্রজেকশন করা হয়নি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সাইফুলস্নাহ মুনশি বলেন, একটা দেশের মধ্যে ডেমোগ্রাফি, স্বাস্থ্য সুবিধা এবং এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্ভ তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায় যে, রোগের পিকটা কখন হবে। তার মতে, বাংলাদেশে এটা করা হলে, কোনো সময় পিকটা হবে তার ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের সেটা করা হয়নি। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল হওয়ায় দেশে করোনার ঊর্ধ্বগতি দীর্ঘমেয়াদি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এদিকে গত এক মাসে করোনার নমুনা পরীক্ষার কেন্দ্র বেশ কয়েকটি বাড়ানো হলেও তা এখনো প্রয়োজনের তুলনা বেশ কম বলে মনে করেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, পর্যাপ্ত পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় দেশে করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া পরীক্ষা করতে ও ফলাফল পেতে আক্রান্ত রোগীকে অনেক জায়গায় যেতে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এতে ব্যাপক হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। এ অবস্থায় করোনা শনাক্তের পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানোর পাশাপাশির্ যান্ডম টেস্টের তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে পিসিআর মেশিন আছে, এর সব জায়গাতেই দ্রম্নত করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। আর হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে যতবেশি শনাক্ত করা যাবে, ততবেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। নইলে করোনায় লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে পরীক্ষার হার বাড়ানোর পাশাপাশি করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রেসপেটরি মেডিসিন, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, অ্যানেসথেলজিস্ট ও ইপিডিওমোলজিস্ট এই পাঁচ ধরনের বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং টিম গঠন করা জরুরি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে শুরুতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি ছিল। আইইডিসিআর মনে করেছিল, তারা একাই সামাল দিতে পারবে, তারা ছাড়া আর কেউ পরীক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সারাদেশে ৬০০ মাইক্রোবায়োলজিস্ট আছেন এবং সমপরিমাণ প্যাথলজিস্টও রয়েছেন। তারা করোনা পরীক্ষা করতে অভিজ্ঞ। সব মেডিকেল কলেজে মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজি বিভাগ চালু আছে। কিন্তু শুরুতে সঠিক পরিকল্পনা ছিল না। আসলে মেডিকেল বিষয়ে পরিকল্পনা মেডিকেল পারসনদের দিয়ে করতে হবে। পলিসি মেকাররা শুধু লজিস্টিক সাপোর্ট দেবেন। তিনি পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেন, এক হাসপাতালে ভর্তি একজন করোনা রোগীর এক্সরের জন্য তাকে অন্য রোগের একটি ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো করোনার সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। এই অবস্থার নিরসন করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে