বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে নমুনা পরীক্ষার জটে শনাক্তের হারে ওঠানামা

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৩ মে ২০২০, ০০:০০
করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় গত ২৪ এপ্রিল দেশে ৫০৩ জন রোগী শনাক্ত করা হলেও এর এক দিন পর অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল এ সংখ্যা বিস্ময়করভাবে হ্রাস পেয়ে ৩০৯ জনে এসে দাঁড়ায়। অথচ এর মাত্র দুদিন পর ২৮ এপ্রিল প্রায় একই সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করে ৫৪৯ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। আবার পরের দিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল ৬৪১ জন রোগীকে করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হলেও পরবর্তী তিন দিন এ সংখ্যা ওঠানামার মধ্যে থেকে ২ মে তা ৫৫২ জনে নেমে আসে। শুধু উলিস্নখিত দিনগুলোই নয়, গত ১৫ দিনে করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এবং রোগী শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করলেও একই ধরনের এলোমেলো ওঠানামার চিত্র পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় একই সংখ্যক নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের এই ওঠানামার পরিসংখ্যান চিত্র অনেকটাই বেমানান। করোনাভাইরাসের এখন পর্যন্ত প্রায় তিনশত রকমের স্ট্রেইন আবিষ্কৃত হয়েছে, একেক অঞ্চলে একেক স্ট্রেইনের প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসের আচরণগত পরিবর্তন দেখা গেছে। তবে নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার সবখানেই একই গতিতে ওঠানামা করেছে। যখন এর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে, তখন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উপরের দিকেই উঠছে। তারপর যখন নিচে নামা শুরু করেছে, তখন ধীরে ধীরে নিচের দিকেই নেমেছে। অথচ দেশে এ পরিসংখ্যান চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এ সংক্রান্ত গ্রাফ ঘন ঘন ওঠানামার জন্য স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা করোনা টেস্টের নমুনা 'ব্যাকলগ' কে দায়ী করেছেন।

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন যে সংখ্যক নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, দক্ষ জনবলের অভাবে কোনো কোনো দিন তার সম্পূর্ণ অংশ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কিছু নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই জমা রেখে দিতে হচ্ছে। যা পরের দিনের সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে যোগ করে পরীক্ষার পর ফলাফল দেওয়া হচ্ছে। এতে ওইদিন শনাক্তের হার বেশি দেখাচ্ছে। অথচ এ 'ব্যাকলগের' কারণে আগের দিন রোগী শনাক্তের হার কম দেখানো হয়েছে।

আবার সরকারি ছুটির দিনগুলোতে কোথাও কোথাও কোনোরকম টেস্টই হচ্ছে না।

\হফলে পরের দিন শনাক্তের হার কম দেখাচ্ছে। যা শনাক্তের হারের ওঠানামার অন্যতম আরও একটি কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এছাড়া শনাক্তের হারে এরকম ফ্লাকচুয়েশনের আরেকটি কারণ হলো 'স্যাম্পল কালেকশনে ফাংশনাল এরোর'। স্যাম্পল কালেকশনে যেমন সূক্ষ্ণ ইন্সট্রুমেন্টাল সাপোর্ট দরকার, তেমনি ল্যাব টেকনিশিয়ানসহ দক্ষ অন্যান্য জনবল দরকার। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ জন ল্যাব টেকনিশিয়ান দিয়ে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্যাম্পল কালেকশান করা হচ্ছে। এছাড়া আরও যারা স্যাম্পল কালেকশন করছে, তারা ল্যাব টেকনিশিয়ান নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্যাকমো বা এই ধরনের অদক্ষ জনবল দিয়ে স্যাম্পল কালেকশন করানো হচ্ছে। ফলে ফাংশনাল এরোরের সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং বা স্যাম্পল টেস্টিং কোনোটাই করোনার উপশম নয়। অথচ এরপরও এসব ব্যাপারে জোরালো তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কারণ আমরা যদি প্রোপার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে তাদেরকে টেস্ট করাতে পারি তাহলে শনাক্তের মোটামুটি একটা বাস্তব চিত্র পাব। পাশাপাশি শনাক্তদেরকে যথাযথ কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা করে করোনার বিস্তার সামগ্রিক হারে বেঁধে ফেলা সম্ভব হবে। যেহেতু করোনার কোনো কার্যকরী ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি তাই এটাই আপাতত 'ওষুধ' হিসেবে সারাবিশ্বে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা যদি সেই কাজটুকুও গুরুত্ব দিয়ে করতে না পারি, আমরা যদি প্রোপার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং আর টেস্টিংয়ের মাধ্যমে এখনো করোনা আটকাতে না পারি তাহলে তা অনেকটা কানামাছি খেলার মতো হবে- যোগ করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, 'শনাক্তের সংখ্যার গ্রাফের এই নিয়মিত ও অবধারিত ফ্লাকচুয়েশন পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয়েছে বা হচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। তিনি এর কারণ হিসেবে উলিস্নখিত বিষয়গুলোর বাইরে আমাদের আচরণগত পরিবর্তনকেও বিশেষভাবে দায়ী করেন। প্রবীণ এই চিকিৎসকের ভাষ্য, বস্তুত, আমাদের দেশে করোনা যতটা না পরিবর্তিত হচ্ছে, তার চেয়ে আমরা বেশি পরিবর্তিত আচরণ করছি। আমরা কখনো গার্মেন্টস্‌সহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, সাধারণ দোকানপাট খুলে দিচ্ছি, আবার কখনো বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাদের কাছে জীবনের চেয়ে জীবিকার মূল্যই বেশি। আমাদের এই পরিবর্তিত আচরণে করোনা নিজেও হয়তো হতভম্ভ হয়ে আছে।'

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, যদি কোথাও ১০ জন রোগী শনাক্ত হয় এবং তাদের প্রত্যেকে যদি নূ্যনতম ১০ জনের সংস্পর্শে আসেন, তবে নতুন করে আরও অন্তত ১০-১২ জনের করোনা পজেটিভ আসার কথা। এছাড়া দেশে যেহেতু ইতোমধ্যেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেছে সেহেতু কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের বাইরেও আরও কিছু রোগী শনাক্ত হবে। সেক্ষেত্রে প্রথম দিনে শনাক্ত ১০ জন রোগীর বিপরীতে পরদিন নূ্যনতম ১৫ থেকে ২০ জনের সংক্রমিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ দেশে এ চিত্র বরাবরই এলোমেলোভাবে ওঠানামা করছে। যা পুরোই 'রেগুলারলি ইরেগুলার' অবস্থা।

এদিকে দেশে গত ১৫ দিনের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এবং রোগী শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করলেও একই ধরনের এলোমেলো ওঠানামার চিত্র পাওয়া গেছে। গত ২৫ এপ্রিল ৩ হাজার ৩৩৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩০৯ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়ে। এ হিসাবে করোনা শনাক্তের হার ৯.২৫ শতাংশ। ২৬ এপ্রিল এ হার ছিল ১২.০৩ শতাংশ; ২৭ এপ্রিল ছিল ১৩.০৩ শতাংশ, ২৮ এপ্রিল ছিল ১২.৬৭ শতাংশ, ২৯ এপ্রিল ছিল ১২.৯০ শতাংশ, ৩০ এপ্রিল ছিল ১১.৩৫ শতাংশ।

এছাড়া পহেলা মে ৫ হাজার ৫৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয় ৫৭১ জন। এ হিসাবে শনাক্তের হার ১০.২৪ শতাংশ। ২ মে শনাক্তের হার ৯.৪৭ শতাংশ, ৩ মে শনাক্তের হার ১২.৩৮ শতাংশ, ৪ মে শনাক্তের হার ১০.৯৯ শতাংশ, ৫ মে শনাক্তের হার ১৩.৭৬ শতাংশ, ৬ মে শনাক্তের হার ১২.৬৫ শতাংশ, ৭ মে শনাক্তের হার ১২.০৩ শতাংশ, ৮ মে শনাক্তের হার ১১.৯৩ শতাংশ, ৯ মে শনাক্তের হার ১১.৬৩ শতাংশ এবং ১০ মে শনাক্তের হার ছিল ১৫.৪৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যার সঙ্গে রোগী শনাক্তের হারে যে তাল থাকার কথা সেটিও সঠিকভাবে মিলছে না। বরং এ হার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এর কারণ হিসেবে নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরীক্ষা পর্যায়ের দুর্বলতাকেই বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে তারা নমুনা পরীক্ষার গতি-পরিধি ও দক্ষতা আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে ঢাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি মনে হলে বাস্তবিক অর্থে এ চিত্র সঠিক কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্যান্য জেলা শহর এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো হলে সেখানেও বিপুল সংখ্যক রোগী শনাক্ত হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে বলেন, জ্বর, সর্দিকাশি, গলাব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্টের মতো কোনো উপসর্গ নেই, অথচ নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ ধরা পড়ছে দেশে বর্তমানে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যা এ মরণব্যাধির প্রকোপ বিস্তারের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাইর্ যান্ডাম নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন কিংবা চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দ্রম্নত উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে অল্পবিস্তর নমুনা পরীক্ষার মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<99321 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1