বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে মরিয়া সরকার

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

বিদেশ থেকে আসেননি, এমনকি বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শে আসারও ইতিহাস নেই, অথচ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন- এ ধরনের স্বল্পসংখ্যক রোগী এরই মধ্যে হাসপাতালে আসতে শুরু করেছে। এতে দেশে কমিউনিটি সংক্রমণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে। ঘনবসতিপূর্ণ, নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এ দেশে কমিউনিটি সংক্রমণ হলে প্রাণহানির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে। এমনকি তখন তা সামাল দেওয়ায় বেশ কঠিন হবে। এ অবস্থায় কমিউনিটি সংক্রমণ রোধ করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি ধাপে ধাপে আরও নতুন পদক্ষেপ বাড়ানোর প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে মূল কৌশল হিসেবে 'লকডাউন' পদ্ধতিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে হোম কোয়ারেন্টিন এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে সেনাবাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও সারা দেশে অঘোষিত লকডাউনের মূল লক্ষ্য পূরণে রাস্তাঘাটে বিনা প্রয়োজনে ঘোরাঘুরি এবং অপ্রয়োজনে চলাচলরত মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত যান বন্ধের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। এমনকি সরকারের ঘরে থাকার নির্দেশ উপেক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে মামলা রুজুরও প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ লিখিত আদেশ না দিলেও এ ব্যাপারে তাদের মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছে সরকার। করোনা মোকাবিলায় দ্রম্নত দক্ষ চিকিৎসকদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে এ রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জামাদি। বিশেষ করে ভেন্টিলেটর পরিষেবা আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলা, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেউ করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে যাতে দ্রম্নত তার টেস্ট করানো যায় সে ব্যাপারেও জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি জ্বর-সর্দি-কাশি-গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে কোথাও কেউ মারা গেলে তার মৃতু্যর কারণ শনাক্ত না হওয়ায় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের কোয়ারেন্টিনে রাখার এবং প্রয়োজনে ওই এলাকা লকডাউন করে রাখতে স্বাস্থ্য বিভাগ ও পুলিশকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কেননা কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে হলে দেশের সর্বত্র সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষা ছাড়াও এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির মৃতু্যর কারণ শনাক্ত করা জরুরি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসায় দক্ষ ও অভিজ্ঞসহ ৫শ চিকিৎসকদের একটি তালিকা তৈরির কাজ এরই মধ্যে হাতে নেওয়া হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করে চিকিৎসকদের কাকে কোন হাসপাতালে সংযুক্ত করা হবে তা নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে এসব চিকিৎসককে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তা দ্রম্নততার সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে পর্যায়ে রয়েছে তা সামাল দেওয়ার যথেষ্ট প্রস্তুতি চিকিৎসকদের রয়েছে। তবে আকস্মিক তা ক্ষিপ্ত গতি পেতে পারে- এমন শঙ্কা মাথায় রেখে সার্বিক প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হচ্ছে। যাতে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। সংকটকালীন সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, করোনা মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছুটি দ্বিতীয় ধাপে বাড়িয়ে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত করা হলেও উদ্ভূত বেসামাল পরিস্থিতিতে তা আরও দীর্ঘ করারও প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। এমনকি কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজনে সারা দেশে আনুষ্ঠানিক লকডাউনের ঘোষণাও আসতে পারে। তবে ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি ও আনুষ্ঠানিক লকডাউনের বিষয়টি পুরোপুরি আগামী এক সপ্তাহের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাইরোলোজিস্ট বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস মানুষের শরীর ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বাঁচতে পারে না। তাই দেশে এ ভাইরাসটি স্টেজ-টু পর্যায়ে থাকা অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনদের কারও সংস্পর্শে না এলে তা আর ছড়িয়ে পড়তে পারত না। এই পর্যায়ে আক্রান্ত মানুষকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। অথচ সে সুযোগ আমরা এরই মধ্যে কিছুটা হলেও হারিয়েছি। যে কারণে তা মৃদু আকারে হলেও স্টেজ-থ্রি পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই এ পর্যায়ে সামান্য অসচেতন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা করোনাভাইরাস পুরোপুরি স্টেজ-থ্রিতে পৌঁছলে এর সংক্রমণের উৎস আর কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে এই সময় এ প্রাণঘাতী ভাইরাসটি সমাজের বিভিন্নস্তরে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত গতিতে ছড়িয়ে পড়বে। অথচ তার উৎস অজানাই রয়ে যাবে। ফলে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক এর ভয়াবহতা প্রকাশ করতে চীনের এ সময়কালীন পরিস্থিতিতে তুলে ধরে জানান, সেখানে করোনাভাইরাসের স্টেজ-থ্রি হিসেবে ধরা হয় ১২ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত সময়কে। ১২ ফেব্রম্নয়ারি এক দিনে চীনে ১৪ হাজার ১০৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। সেদিন চীনে মৃতু্য হয় ১৪৬ জনের। এছাড়া ২৩ ফেব্রম্নয়ারি চীনে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃতু্য হয় ১৫০ জনের।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পুরোপুরিভাবে স্টেজ-থ্রিতে পৌঁছলে তা কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা সরকারকে গভীর চিন্তায় ফেলেছে। আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নূ্যনতম এক হাজার নতুন কেস সামাল দেওয়ার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি এখনই দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে নেওয়া জরুরি বলে তারা সরকারকে সতর্ক করেন তারা।

স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের মৃতু্যহার সার্স অথবা মার্স-এর থেকে অনেক কম হলেও নতুন এই ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও তাদের কাছে বিশেষ তথ্য নেই। চীনে এ ভাইরাসটি স্টেজ-ফোর-এ পৌঁছলেও সেখানকার থেকেও ইতালিতে মৃতু্যর হার অনেক বেশি। তাই এ ব্যাপারে আগেভাগেই অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

এদিকে সম্প্রতি যারা বিদেশ থেকে ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকেননি, এমনকি বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও নিজের উপস্থিতি প্রশাসনকে নিশ্চিত করেননি তাদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর অ্যাকশনে নামছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলা ও প্রস্তুতি নিয়ে এক বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

হোম কোয়ারেন্টিন না মানা প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনী এরই মধ্যে মাঠে নামলেও এবার তার গতি-পরিধি আরও কয়েকগুণ জোরদার করছে। তারা বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে সম্প্রতি দেশে আসা প্রবাসীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেউ হোম কোয়ারেন্টিন না মানলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সাফ দিচ্ছেন।

এদিকে দেশের অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নআয়ের মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে যাতে দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহে রাস্তায় নামতে না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা, এ শ্রেণির বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘরে খাবার না থাকলে তারা লকডাউন ভেঙে নির্বিচারে রাস্তায় নেমে আসবে। এতে করোনাভাইরাসকে স্টেজ-থ্রিতে আটকে রাখা কঠিন হবে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95229 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1