বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা উপসর্গে বাড়ছে মৃত্যু, জনমনে উদ্বেগ

সাখাওয়াত হোসেন
  ০১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০১ এপ্রিল ২০২০, ১১:২৪

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা পাঁচ এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মঙ্গলবারই অর্ধশতের কোটা ছাড়ালেও এই মরণ ব্যাধির নানা উপসর্গ নিয়ে সন্দেহভাজন রোগীর মৃতু্যর সংখ্যা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও জ্বর-কাশি-সর্দি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক বা একাধিক নারী-পুরুষ কিংবা শিশুর মৃতু্য ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অস্বাভাবিক মৃতু্যর কারণ শনাক্ত করা না হলেও মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিল- এমন সন্দেহে স্থানীয় জনগণ কিংবা প্রশাসন তার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরও কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য করছে। এমনকি কোনো কোনো এলাকা লকডাউন করে দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে জনমনে বাড়ছে নানামুখী শঙ্কা। দেশের বেশকিছু এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের শঙ্কা, করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির মৃতু্যর প্রকৃত কারণ শনাক্ত করা না হওয়ায় জনমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যা একপর্যায়ে চরম অস্থিতিশীলতায় রূপ নেবে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বিদেশফেরত ব্যক্তি ও তার ঘনিষ্ঠজনরা করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে তাদের অধিকাংশের করোনা পরীক্ষা করা হলেও একই ধরনের অসুস্থতা নিয়ে মৃত সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার নজির নেই বললেই চলে। এতে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস কতটা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা অজানাই রয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে এই রোগের ভয়াবহতা ও প্রকোপ নিয়ে জনমনে দুই ধরনের ধারণা জন্ম নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আইইডিসিআরের পরিসংখ্যানে দেশে করোনাভাইরাসে স্বল্পসংখ্যক মানুষের মৃতু্য ও সংক্রমিত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হলেও বিভিন্ন এলাকায় এই রোগের উপসর্গ নিয়ে একাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্থ এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর যে জনআস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা সাধারণ মানুষের আলাপচারিতায় প্রকাশ পাচ্ছে। এদিকে এ নিয়ে এরইমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ভিন্নমুখী বিভ্রান্তিরও সৃষ্টির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ততোটা প্রকট নয়- এমন ধারণা নিয়ে একশ্রেণির মানুষ এরই মধ্যে ফের আগের মতো অসচেতনভাবে চলাফেরা শুরু করেছে। প্রয়োজন ছাড়াই তাদের অনেকে অযথা রাস্তাঘাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতামূলক কার্যক্রম ও হাচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা থেকেও তারা অনেকটা বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে জ্বর-সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যারা মারা যাচ্ছেন, তারা সবাই করোনায় আক্রান্ত ছিলেন- এমন বিশ্বাসে অপর একশ্রেণির মানুষ অস্বাভাবিক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন। যা এই রোগের প্রকোপ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। উদ্বেগজনক এই বিষয়টিতে সহমত পোষণ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে করোনার প্রকোপ যে মাত্রাতেই পৌঁছে না কেন, জনসম্মুখে এর সঠিক চিত্র তুলে ধরা জরুরি। কেননা, তা না হলে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে। এতে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে অসচেতনতা বাড়বে। অন্যদিকে অপর একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ভয়াবহ রূপ নেবে। এই সুযোগে কুচক্রীমহল নানামুখী গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপতৎপরতা চালাতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। তাদের এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, সেটা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে জ্বর-কাশি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে ১৯ জনের অস্বাভাবিক মৃতু্য হয়েছে, এর খবর বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত জাতীয় দৈনিকের পেপার কাটিংও কোনো কোনো পোস্টে সংযুক্ত রয়েছে। আইইডিসিআরের দাবি অনুযায়ী তাদের কারও মৃতু্য করোনাভাইরাসে না হলেও তাদের অনেকেই করোনার আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সে তথ্যও ওইসব পোস্টে দেয়া হয়েছে। বিগত সময় জ্বর-কাশি-সর্দি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এ ধরনের মৃতু্যর মিছিল শুরু না হলেও এখন কেন এটি হচ্ছে, স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের কাছে অনেকেই এ প্রশ্নও রেখেছেন। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের দেয়া করোনা-বিষয়ক তথ্যের সঙ্গে আইইডিসিআরের পরিসংখ্যানের কোনো মিল নেই বলেও নেটিজেনরা অভিযোগ তুলেছেন। এসব পোস্টের অধিকাংশই এখন 'ভাইরাল'। এদিকে ফেসবুকারদের এসব অভিযোগ ও বক্তব্য যে একেবারে অসত্য নয়, সেটা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ মার্চ সর্বশেষ ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা যান। তিনি বিদেশ থেকে আসা এক রোগীর পরিবারের সদস্য। তিনি করোনা আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন গত ১৮ মার্চ। এরপর থেকে তিনি তার এলাকার একটি হাসপাতালে আইসোলেশনে ছিলেন। তাকে সেখান থেকে ঢাকায় আনা হয় গত ২১ মার্চ এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে রাখা হয়। ২৫ মার্চ সকালে তিনি মারা যান। অথচ দিনাজপুর সিভিল সার্জন মো. আবদুল কুদ্দুস জানান, জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ৩০ মার্চ ফরহাদ হোসেন নামের এক দিনমজুর মারা যান। তিনি কুষ্টিয়ায় শ্রমিকের কাজ করতেন। বিরামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহসিয়া তাবাস্‌সুম এ খবরের সত্যতা স্বীকার করে জানান, খবর পেয়ে তার নেতৃত্ব পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি দাফন টিম দিনমজুর ফরহাদ হোসেনের দাফন সম্পন্ন করেছেন। এরপর আচোলকোল গ্রামের ৫০টি বাড়িতে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এদিকে ৩১ মার্চ রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে আরও এক ব্যক্তির মৃতদেহ দাফন করা হয়েছে। তার মধ্যে করোনার লক্ষণ ছিল বলে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওই ব্যক্তিকে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে রাত ১টার দিকে তিনি মারা যান। হাসপাতালের মৃতু্যর প্রমাণপত্রে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। এই উপসর্গের কারণে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় তিনি মারা যান। অথচ মৃত ব্যক্তিকে দাফনের জন্য মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুল হাসপাতালের যে ছয়জন এসেছিলেন, তারা সবাই পিপিই পরিহিত ছিলেন। এদিকে সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে সোমবার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের এক ব্যক্তির মৃতু্য হয়েছে। কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ওই ব্যক্তি তিনদিন ধরে সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি করানোভাইরাস আক্রান্ত হতে পারেন। এ জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আইইডিসিআরের নিয়ম মেনে লাশ দাফন করা হবে। এর আগে গত ১৯ মার্চ জ্বর, গলা ব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে খুলনায় দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সম্প্রতি ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন। ওই রোগীর স্বজনরা বলেছেন, উপসর্গ শুনেই চিকিৎসকরা ভয় পেয়ে রোগীর কাছে আসেননি। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, মৃত ওই দুইজনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ ছিল। তাদের মধ্যে একজন ভারত থেকে এসেছেন। কিন্তু করোনা পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের করোনা হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে কোথাও করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এ কারণে চিকিৎসকরাও আতঙ্কে। অন্যদিকে গত ২৯ মার্চ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় জ্বর-কাশি নিয়ে এক নারী মারা যাওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন পুরো উপজেলা লকডাউন করে দেয়। একই সঙ্গে ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে ৩১ মার্চ আইইডিসিআর নমুনা পরীক্ষা করে জানায়, ওই নারী করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। এরপর ওই এলাকার লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এদিকে সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও গলা ব্যথা নিয়ে আক্রান্ত কাকলি নামের ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে গত ২৯ মার্চ যশোর জেনারেল হাসপাতালে আইসোলেশনে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হলেও ৩০ মার্চ তার মৃতু্যর পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সে করোনায় সংক্রমিত ছিল না। এ কারণে তার করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে