শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকে ঘিরে দুর্বোধ্য শব্দের সমাহার, জনমনে বিভ্রান্তি

জাহিদ হাসান
  ২৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলা ও চিকিৎসাসম্পর্কিত শব্দের দুর্বোধ্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে। এতে করে চলমান ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন হতে গিয়েও অনেকে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ভাইরাসটি সম্পর্কে জনসাধারণকে সহজে বোঝাতে চিকিৎসা পরিভাষা শব্দের সহজ প্রয়োগ ও পরিচিত শব্দ ব্যবহারে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরেজমিন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কিত খবর প্রচারণায় গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জটিল ইংরেজি শব্দগুচ্ছ বা বাক্য ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষ এসব কথার অর্থ সহজে ধরতে পারছেন না। এতে করে তারা সচেতন হওয়ার পরিবর্তে বেশি পরিমাণে আতঙ্কিত হচ্ছেন। ভাইরাস প্রতিরোধের পূর্ব-প্রস্তুতি সংক্রান্ত কথাবার্তা বুঝতে অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এমনকি এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার ফলে নিজেদের অজান্তে একে অন্যের মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তারা বলছেন, বর্তমানে আলোচিত নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড (১৯) নাইনটিন, আইসোলেশন (পৃথকীকরণ), কোয়ারেন্টিন (প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঙ্গ-নিরোধ), হোম কোয়ারেন্টিন (ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সঙ্গ-নিরোধ), স্যানিটাইজার বা হ্যান্ডরাব (নির্বিষকরণ উপাদান বা জীবাণুনাশক

উপাদানের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা), পারসোনাল প্রোটেক্টটিভ ইকুয়েপমেন্ট বা পিপিই (সুরক্ষা সরঞ্জাম), থার্মাল স্ক্যানার (তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র), লোকাল ট্রান্সমিশন (নির্ধারিত এলাকার সংক্রমণ ঝুঁকি), কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমণ ঝুঁকি), শাটডাউন বা লকডাউন, (অবরুদ্ধ বা তালাবদ্ধ এলাকা), কন্টেইনমেন্ট (নিয়ন্ত্রিত এলাকা), ডাবিস্নওএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা), এপিডেমিক (মহামারি), প্যান্ডোমিক (দেশ বা পৃথবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া), জিনোম সিকোয়েন্স (রোগের বংশ বিস্তার ধারা) বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেগুলো নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাস সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে বিভিন্ন ধরনের হাস্যরসাত্মক শব্দ বা বাক্য তৈরি করছে।

বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাষা সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকলে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অপ্রচলিত শব্দ ও বাক্য বুঝতে সময় লাগে। কারণ কোনো বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকলে অর্থ বুঝতে পারে না। এতে করে অতি আলোচিত ব্যাপার হলেও সে ব্যাপারে দুয়েকটি করণীয় পদ্ধতি জানা ছাড়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা জানা যায় না।

তারা আরও বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ইংরেজি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় চিকিৎসা শাস্ত্রসহ প্রায় সব বিষয়েই এটির প্রাধান্য রয়েছে। যদিও মানুষ বাধ্য হয়ে তা রপ্ত করার চেষ্টা করছে। তবে মনে রাখতে হবে, বাঙালিরা একমাত্র জাতি ভাষার জন্য যাদের জীবন দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। সুতরাং সাধারণ জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হলে সাবলীল শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে তা বোঝাতে হবে।

বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে গ্রাম ও শহরে বসবাসকারী একাধিক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা যায়যায়দিনকে বলেন, এদেশের মানুষ উদারাময়ের অর্থ বুঝতে না পারলেও কলেরা কী তা বোঝে। একইভাবে আইসিইউ সেবা বলতে নিবিড় পরিচর্যা বা অন্তিম সময়ের চিকিৎসা, কারফু্য (কারফিউ) অর্থ জরুরি অবস্থা বোঝেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হওয়া শব্দ যেমন; ক্যানসার, ধুনস্টংকার, টিটেনাস টিকা, আয়োডিন শব্দের সঙ্গে পরিচিত। তবে নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ সম্পর্কে সদ্য আলোচিত কোয়ারেন্টিন, হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন শব্দের সঠিক অর্থ ও করণীয় সহজে বুঝতে পারছে না।

আর এ কারণে অতীতে মহামারি রোগ কলেরাকে (ইংরেজি শব্দ) এদেশের সাধারণ মানুষ ওলাওঠা বা ওলা বিবি নামে ডেকেছে। একইভাবে স্মল পক্সকে গুটি বসন্ত, বস্ন্যাক ফিভারকে কালাজ্বর, আর্থ্রাইটিস বা রিউম্যাটিস রোগকে বাতের ব্যথা, কুকুরের কামড়ের ফলে হাইড্রো ফোবিয়া রোগকে জলাতঙ্ক, মানসিক রোগীকে পাগলের রোগ, অ্যাকজিমাজনিত চর্মরোগকে বিখাউজ, কাউর ঘা। সাদা চামড়াবিশিষ্ট মানুষকে শ্বেত বা শ্বেতী রোগী, লুজ মোশনকে পাতলা পায়খানা, অ্যাজমাকে সহজ ভাষায় হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট, টিউবারক্লুসিস বা টিবিকে যক্ষ্ণা, গর্ভবতী নারীদের অ্যাকলামশিয়া সমস্যাকে খিঁচুনি, ডিসেন্ট্রিকে আমাশয়, মাইগ্রেন বা হেইডেককে মাথা ধরা বা মাথা ঘোরা রোগ বলে অভিহিত করেছেন।

বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী একমত পোষণ করে যায়যায়দিনকে বলেন, চলমান করোনাভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নত-অনুন্নত সব দেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। মনে রাখতে হবে যেকোনো বিষয়ে স্বাক্ষরজ্ঞান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভাইরাস সম্পর্কে জানাতে বেশ কিছু নতুন শব্দ ব্যবহার করছে। আবার গণমাধ্যমগুলোও অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করে সংবাদ প্রচার করছে। সাধারণ মানুষের কাছে শব্দগুলো নতুন হওয়ায় করোনাভাইরাস কী কিভাবে ছড়ায়, প্রতিরোধ ব্যবস্থা কী অনেককে বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাই বিষয়গুলো জনগণের কাছে সহজ-সরলভাবে তাদের নিজের ভাষায় উপস্থাপন করা জরুরি। এ জন্য স্বাক্ষরজ্ঞানহীন মানুষকে বোঝাতে কোয়ারেন্টিনকে সঙ্গ নিরোধ, থার্মাল স্ক্যানারকে তাপমাত্রা পরিমাপক বলে প্রচার করা উচিত। আর বৈশ্বিকভাবে প্রতিটা দেশের ভাষাবিদ-চিকিৎসক ও গণমাধ্যম কর্মীদের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রচলিত ভাষায় প্রচার করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ করোনাভাইরাসের সঙ্গে পরিচিত হলেও কোভিড-১৯ বা কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন জাতীয় শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত না। এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষের কাছে শব্দগুলো নতুন। এতে করে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছাড়াচ্ছে। সুতরাং পেন্ডামিক, জিনোম সিকোয়েন্স, প্যানিক, শাটডাউন, লকডাউন, কন্টেইনমেন্ট এসব চিকিৎসা পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ না করে দেশীয় শব্দ ব্যবহারে সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। সাবলীল ভাষা ব্যবহার করে মূল বার্তা পৌঁছায়ে দিতে হবে। এতে করে ভাইরাস সম্পর্কে জানা ও মোকাবিলা সহজ হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94293 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1