শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাবির একটি হলের ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মরদেহ এভাবেই পড়ে ছিল -ফাইল ছবি

আজ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়ে দিকে দিকে ছুটে গেল সাঁজোয়া গাড়ির বহর। 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে হননতৃষ্ণা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাংক নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে গর্জে উঠে বন্দুক, কামান আর ট্যাংক। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে রাতের বাতাস। ইতিহাসের পাতায় রচিত হয় কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হয় বিশ্ববিবেক।

রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে তাদের অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের শহর। শুধু সেখানেই নয়, দেশের বিভিন্নস্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করে অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত মানুষ।

শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকান্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জলস্নাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) সামনে সাকুরার পেছনের গলিতে

থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে পেট্রল ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এরপর একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও জাতীয় প্রেসক্লাবে অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা।

মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাংক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি জলস্নাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনের দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে।

চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহিদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের প্রায় ৫০ ছাত্রী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছিল শহরের সব জায়গায়। সেই রাতে রাজারবাগে পুলিশ সদর দপ্তরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রম্নর ট্যাংক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দপ্তর। সে রাতে ১১শ বাঙালি পুলিশের রক্ত ঝরিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দিয়েছিল সবকিছু।

এদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারে এ রাতে চালানো হয় 'অপারেশন বিগ বার্ড'। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে এ ঘটনার নায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান। একাত্তরে কুমিলস্না ক্যান্টনমেন্ট থার্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

সন্ধ্যার পর কোম্পানিকে অভিযানের নির্দেশনা বুঝিয়ে দেন জহির। কোম্পানিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। নেতৃত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে ক্যাপ্টেন সাঈদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও মেজর বিলস্নালের ওপর। তিনটি দলের মিলিত হওয়ার স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এমপি হোস্টেলের দিকে মুখ করে থাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরের গেট। ঠিক হয় বিমানবন্দর থেকে সংসদ ভবন ও মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমন্ডি যাবেন তারা। রাত ৯টার দিকে জহির এয়ারফিল্ডে পৌঁছলেন।

২৫ মার্চ রাত ১১টায় জহির নেতৃত্বে এয়ারফিল্ড থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে জিপ নিয়ে সাথে তিনটি ট্রাক বের হয় শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল পাশের একটি বাসায় ঢুকে দেয়াল টপকে নামেন মুজিবের আঙ্গিনায়। এ সময় গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। বাড়ির বাইরে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদস্যরা তাদের ১৮০ পাউন্ড ওজনের তাঁবুতে ঢোকে, সেগুলো খুঁটিসহ তুলে নিয়ে ঝাঁপ দেয় ধানমন্ডির লেকে। সংলগ্ন এলাকার নিরাপদ দখল শেষ। ঘন কালো আঁধার চারদিকে। মুজিব ও তার প্রতিবেশী কারও বাসাতেই বাতি নেই। তলস্নাশি চালানোর জন্য এরপর একটি দল ঢুকল। প্রহরীদের একজনকে বলা হলো রাস্তা দেখাতে। কিছুদূর যাওয়ার পর তার পাশে থাকা সৈন্যকে দা দিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিল সে, কিন্তু জানত না তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তাকে গুলি করে আহত করা হয়। এরপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল সার্চপার্টি। একের পর এক দরজা খুলে কাউকে পাওয়া গেল না। একটা রুম ভেতর থেকে আটকানো ছিল।

এরপর গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও তার সাথে সাব-মেশিনগানের ব্রাশফায়ার। তারা ভেবেছিল কেউ হয়তো শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। বাধা দেওয়ার আগেই বারান্দার যেদিক থেকে গুলি এসেছিল সেদিকে গ্রেনেড ছোড়ে একজন সৈনিক। এরপর সাবমেশিনগান চালায়। গ্রেনেডের প্রচন্ড বিস্ফোরণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজে বদ্ধ সে রুমের ভেতর থেকে চিৎকার করে সাড়া দেন শেখ মুজিব এবং বলেন তাকে না মারার প্রতিশ্রম্নতি দিলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। নিশ্চয়তা পেয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। পরে মাঝের ট্রাকে মুজিবকে বসিয়ে ক্যান্টনমেন্টের পথ ধরেন জহিরের দল। তবে তাকে কোথায়, কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে তা জানা না থাকায় সংসদ ভবনে মুজিবকে আটকে রেখে পরবর্তী নির্দেশনা জানতে ক্যান্টনমেন্ট রওয়ানা দেন জহির।

পরে সেখান থেকে সোজা লে. জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরে গেলেন মেজর জহির। সেখানে চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জিলানীর সঙ্গে দেখা করে তাকে জানালেন মুজিবকে গ্রেপ্তারের কথা। জিলানী তাকে টিক্কার অফিসে নিয়ে গেলেন এবং বললেন রিপোর্ট করতে। এ সময় জহিরকে জানানো হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে কক্ষটিতে ছিলেন, সেখানেই রাখা হবে মুজিবকে। এরপর ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে স্থানান্তরিত হলেন তিনি। একটি সিঙ্গেল বেডরুমে তাকে রেখে বাইরে প্রহরার ব্যবস্থা করা হলো। এরপর একটি স্কুল ভবনের (আদমজী ক্যান্টনমেন্ট) চারতলায় মুজিবকে সরিয়ে নেওয়া হলো। সেখান থেকে কয়েক দিন পর করাচিতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94083 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1