আবার এসেছে ফিরে শোকাবহ সেই ২৫ ফেব্রম্নয়ারি, দেশের ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায়। তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের ১১ বছর পূর্তি আজ, শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরের বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই দুই দিনে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং নারী ও শিশু ছাড়াও আরও ১৭ জনকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। দীর্ঘ ১১ বছরেও ওই নির্মম হত্যাকান্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি নিহতদের স্বজনরা।
এদিকে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় হলেও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা এখনো নিম্ন আদালতের গন্ডিই পেরোতে পারেনি। এই মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। তাই হত্যা মামলা থেকে খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে
\হমুক্তি মিলছে না বিডিআরের সাবেক অর্ধসহস্রাধিক সদস্যের। এগারো বছর ধরে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে তাদের। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি ওই নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটে।
পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ওই ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা হয়। একটি হত্যা, অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। হত্যা মামলায় আসামি ছিলেন ৮৫০ জন। অন্যটিতে আসামির সংখ্যা ৮৩৪। দুই মামলায় মোট সাক্ষী ১ হাজার ৩৪৪ জন। হত্যা মামলায় ৬৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ সাক্ষীর সাক্ষ্য হয়েছে।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জানান, ঘটনাস্থল, সাক্ষী ও আসামি একই হওয়ায় দুইটি মামলায় একসঙ্গে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তবে আসামিপক্ষের আবেদনে মামলা দুটির বিচারকাজ পৃথকভাবে চলে। হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালতে রায় হয়। এরপর সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের এই মামলায় নিরাপত্তাজনিত কারণে আদালতে হাজির করা নিয়ে বিলম্ব হয়। এখন প্রতি মাসে তিনটি তারিখে মামলাটির কার্যক্রম চলছে।
এদিকে বিস্ফোরক মামলাটির বিচার দ্রম্নত নিষ্পত্তির জন্য কারাবন্দি বিডিআর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ভুক্তভোগীরা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তাদের কারও স্বামী, কারও বাবা, কারও ছেলে, কারও ভাই বিডিআরে কর্মরত ছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের হয়। যার একটি বিডিআরের প্রচলিত আইনে শেষ হয়। এতে অনেকেরই সাজাভোগ শেষ হয়ে গেছে। এরপর বিডিআরের হত্যা মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন ২৭৮ জন সদস্য। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দুই বছর ১০ মাসের মধ্যে হত্যা মামলাটির বিচারকার্য শেষ হলেও বিস্ফোরক মামলাটি দীর্ঘদিনেও শেষ হচ্ছে না। যার কারণে বছরের পর বছর জেলে পড়ে আছেন হত্যা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া সদস্যরা।
তারা বলেন, ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দুটির চার্জ গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেওয়া হলেও বিস্ফোরক মামলাটি চলমান রয়েছে। দীর্ঘদিনে বিস্ফোরক মামলায় স্বল্প সংখ্যক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার সাক্ষী একই। বিস্ফোরক মামলায় জামিন প্রদানে আইনগত বাধা না থাকলেও হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্তদের একজনকেও জামিন দেওয়া হয়নি। জেলের মধ্য থেকে অনেকে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেকেই। এদিকে বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ২৮৮ জন ও হাইকোর্টে ৩ থেকে ১০ বছরের সাজা হওয়া ২২৮ আসামির সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এই ৫১৬ জনের বিস্ফোরক মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় মুক্তি পাচ্ছেন না তারা। বিচারে আসামিদের যা-ই সাজা হয় হোক, তারা সবাই চায় মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তি হোক।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী শামীম সরদার বলেন, হত্যা মামলায় যারা খালাস পেয়েছিলেন তাদের অনেকেই বিস্ফোরক মামলাতেও আসামি। এর ফলে তারা একটি মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে পিলখানা হত্যাকান্ডের পর পলাতক ২২ সদস্য এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এদের ধরিয়ে দিতে ২ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। তারপরও তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। গ্রেপ্তারের জন্য 'অপারেশনর্ যাবল হান্ট' নামে অভিযানও চালানো হয়েছে। পলাতকদের মধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সে এই ১৪ জনের আপিল হয়নি। বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, পলাতক ২২ বিডিআর সদস্যকে গ্রেপ্তারে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র বলেছে, বিডিআরে বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের সাজা হয় অধিনায়কদের সামারি ট্রায়ালে। এতে ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচু্যত করা হয়। অন্যরা প্রশাসনিক দন্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়। তাদের প্রত্যেককে চাকরিচু্যত করা হয়েছে। আর বেকসুর খালাস পাওয়া ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন। বিচার চলার সময় ৫ জনের মৃতু্য হয়।
প্রসঙ্গত, আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি। এদিন সকালে সর্বোচ্চ আদালতের ওয়েবসাইটে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির ফাঁসির আদেশসংবলিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় আগেই। তবে এতে কোনো ভুলত্রম্নটি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে আরও সময় নেওয়া হয়।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের ওই তিন বিচারপতির ৮ জানুয়ারি সকালে রায়ে স্বাক্ষর করার পর তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আর এই রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় অনুমোদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়।
কর্মসূচি: পিলখানার শহিদদের স্মরণে আজ ওই স্থানে শাহাদতবার্ষিকী পালিত হবে। দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী শহিদদের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে বিজিবির সদর দপ্তরে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক দেবেন। আগামীকাল মঙ্গলবার বাদ আসর পিলখানার কেন্দ্রীয় মসজিদে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।