শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকিপূর্ণ নানা অপ্রচলিত খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এমএলএম চক্রের অপতৎপরতা দ্রম্নত থামিয়ে দেওয়া না গেলে দেশের অর্থনীতিতে চরম মন্দা নেমে আসবে। শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়ম অনুযায়ী বিনিয়োগ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। মধ্যবিত্তের আমানত অপ্রচলিত খাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থ পাচার আরও বাড়বে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে নির্ধারণ এবং সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে আয়কর সনদ বাধ্যতামূলক করায় এ খাতে মধ্যবিত্তের বিনিয়োগ কয়েক মাস আগ থেকেই উলেস্নখযোগ্যভাবে কমেছে। এদিকে সম্প্রতি সরকার ব্যাংক আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চসীমা ৬ শতাংশে বেঁধে দেওয়ায় সেদিক থেকেও অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থার কারণে সেখানেও আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের। এ অবস্থায় নামসর্বস্ব মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি, কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও পাড়া-মহলস্নাভিত্তিক সমিতিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে মধ্যবিত্তের বিনিয়োগ বাড়ছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ডাকঘরে আমানতের সুদের হার কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করায় খুদে বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আর এ সুযোগে মধ্যবিত্তের গচ্ছিত সঞ্চয় হাতিয়ে নিতে একাধিক ধান্দাবাজ চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, এ চক্রের অপতৎপরতা দ্রম্নত থামিয়ে দেওয়া না গেলে দেশের অর্থনীতিতে চরম মন্দা নেমে আসবে। শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়ম অনুযায়ী বিনিয়োগ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। মধ্যবিত্তের আমানত অপ্রচলিত খাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থ পাচার আরও বাড়বে। ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বৃদ্ধি পাওয়ারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। কেননা বিনিয়োগ এবং ব্যাংকের তারল্যের একটি বড় অংশ আসে সঞ্চয় থেকে।

এ পরিস্থিতিতে ঋণের সুদ কমানোর লক্ষ্যে শুধু আমানতের সুদ কমানোর ওপর জোর না দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়, বাহুল্য খরচ কমানোর পাশাপাশি উচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ব্যাংকগুলোকে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

তাদের ভাষ্য, প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে জিডিপির কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ। আর বিনিয়োগের বড় একটি অংশ আসে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। অথচ ব্যাংক আমানতের সুদ ৬ শতাংশ কার্যকর করার পর সঞ্চয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এতে আগামীতে বিনিয়োগ আরও ব্যাহত হবে।

অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা বলেন, সুদহারের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাজারে সরবরাহ বাড়লে এমনিতেই সুদহার কমবে। এ নিয়ে জবরদস্তি করা হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, দেশে বেসরকারি খাতের জন্য কোনো পেনশন পদ্ধতি বা বয়স্ক ভাতা নেই। কষ্টার্জিত গ্র্যাচুইটি বা প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ব্যাংকে রেখে সেই মুনাফা দিয়ে বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়া মধ্যবিত্ত অনেকেই সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে সেখান থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার বাড়তি খরচ মেটান এবং নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের সামাল দিয়ে আসছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ ডাকঘর সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানতের মুনাফা এক লাফে অর্ধেকে নেমে আসায় অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ অপ্রচলিত খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে এরই মধ্যে এসব ঝুঁকিপূর্ণ খাত থেকে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় তছরুপ হওয়ার ঘটনা জ্যামিতিক হারে বাড়ার আলামত দেখা দিয়েছে।র্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী এবং আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে বিপুলসংখ্যক নামসর্বস্ব এমএলএম কোম্পানি, সমবায় সমিতি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে চড়া লাভে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা শুরু করেছে। কোনো কোনো ভুয়া কোম্পানি এরই মধ্যে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় হাতিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী অনেকে আদালতে মামলা করেছেন। কেউ কেউ আবার পুলিশের দ্বারস্থও হয়েছেন।

ঢাকা মহানগরের পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় আগেও থানায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসত। তবে এ ঘটনা সম্প্রতি কয়েকগুণ বেড়েছে। অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়গুলো আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় তাদের সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এসব ফন্দিবাজ চক্র যাতে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় হাতিয়ে নিতে না পারে এ ব্যাপারে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এ চক্রের অপতৎপরতার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সরাসরি প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোরাল উদ্যোগ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীল ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

রামপুরা থানাধীন উলন এলাকার বাসিন্দা সুফিয়া আহমেদ জানান, বেসরকারি চাকুরে স্বামীর মৃতু্যর পর তার সঞ্চিত অর্থ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে সেখান থেকে প্রাপ্ত মুনাফা এবং ছেলের বেতনের সামান্য টাকা দিয়ে তিনি সংসার চালাচ্ছিলেন। বছরখানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলের পা ভেঙে যাওয়ার পর তার চাকরি চলে যায়। এতে গোটা পরিবারে চরম অর্থ সংকট দেখা দেয়। এর ওপর আকস্মিক সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়ানোর পর নতুন করে ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদ কমানোর নির্দেশনা আসায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এ পরিস্থিতি প্রতিবেশী এক গৃহবধূর হাত ধরে 'ঘরণী' নামের একটি সমিতিতে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। প্রথম মাসে ৫ হাজার টাকা মুনাফা দিলেও পরের মাসে মুনাফা পরিশোধের ঠিক আগের দিন ওই সমিতির কর্ণধার আকস্মিক পরিবারসহ উধাও হয়ে যান। যে প্রতিবেশীর মাধ্যমে সুফিয়া ওই সমিতিতে গিয়েছিলেন তিনিও ভাড়া বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় তাকেও আর তিনি খুঁজে পাননি। টানাটানির সংসারে দুই লাখ টাকার পুঁজি হারিয়ে বিধবা এ নারী রীতিমতো পথে বসেছেন।

একই ধরনের প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা খুঁইয়েছেন রাকিব হায়দার নামে নামা মেরাদিয়া এলাকার আরেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তিনি জানান, মাস চারেক আগে তার তিন লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়। তবে তা ভাঙ্গিয়ে নতুন করে আর সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেননি। কেননা নতুন নিয়মে সঞ্চয়পত্র কিনতে আয়কর সনদ দিতে হয়, যা তার নেই। এ অবস্থায় স্থানীয় একটি সমিতিতে ওই টাকা বিনিয়োগ করেন। অথচ মাস দুয়েক আগে ওই সমিতি তার মতো আরও অনেকের লাখ লাখ টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে উধাও হয়ে গেছে। তারা বিষয়টি থানা পুলিশকে অবহিত করেছেন। তবে এখনো এর কোনো সুরাহা হয়নি। পুলিশ ওই প্রতারকচক্রকে এখনো ধরতে পারেনি।

এদিকে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়ানো ও তা ক্রয়ে কড়াকড়ি এবং ব্যাংক আমানতের সুদের হার এক লাফে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশেই মধ্যবিত্তের সঞ্চয় যেমন অপ্রচলিত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, তেমনি তা তছরুপ হওয়ার ঘটনাও ভয়াবহভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে, যা তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

এদিকে এ ঘটনায় দেশের অর্থনীতিবিদরাও এখন উৎকণ্ঠিত। তারা মনে করেন, নানা ধরনের কড়াকড়ি ও আমানতের সুদের হার কমানোর কারণে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও উচ্চবিত্তের সঞ্চয় বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার তথ্যও আর্থিক গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, আমানতের সুদহার কমলে মানুষ টাকা ব্যাংকে রাখতে চাইবেন না। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যারা সঞ্চয় করেন তারা যে শুধু সঞ্চয় দেশে রাখবেন, তা নয়। বিদেশেও সঞ্চয় করতে পারেন। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। তা না হলে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89313 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1